- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতি হলো সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা যা মানব জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সীমিত সম্পদ কিভাবে ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে আলোচনা করে। এটি কেবল অর্থ উপার্জনের বিষয় নয়, বরং এর মাধ্যমে সম্পদের সুষ্ঠ বন্টন, উৎপাদন এবং ভোগের প্রক্রিয়াকে বোঝা যায়। অর্থনীতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা সে ব্যক্তিগত হোক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।
১। সীমিত সম্পদ: অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল ভিত্তি হলো সীমিত সম্পদ। আমাদের প্রয়োজন অপরিসীম, কিন্তু সেই প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ, মানব সম্পদ এবং পুঁজি সীমিত। এই সীমাবদ্ধতার কারণেই মানুষ এবং সমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে কোন চাহিদা পূরণ করা হবে এবং কোনগুলো বাদ দিতে হবে। এই সীমিত সম্পদকে সর্বোচ্চ কার্যকরভাবে ব্যবহার করাই অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য। অর্থনীতির এই মৌলিক নীতিটি প্রতিটি অর্থনৈতিক মডেল এবং সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে কাজ করে।
২। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: একটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হয় তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। মূলত তিন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেখা যায়: পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক এবং মিশ্র অর্থনীতি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং বাজার ব্যবস্থা প্রাধান্য পায়, যেখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকে। আমাদের মতো অনেক দেশে মিশ্র অর্থনীতি বিদ্যমান, যেখানে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় উভয় উদ্যোগই সহাবস্থান করে, যা সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৩। উৎপাদন ও ভোগ: অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো উৎপাদন ও ভোগ। উৎপাদন বলতে পণ্য ও সেবা তৈরির প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যার মাধ্যমে মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। অন্যদিকে, ভোগ হলো সেইসব পণ্য ও সেবা ব্যবহার করার প্রক্রিয়া। একটি সুস্থ অর্থনীতিতে উৎপাদন এবং ভোগের মধ্যে ভারসাম্য থাকা জরুরি। যখন উৎপাদন বাড়ে তখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখে।
৪। চাহিদা ও যোগান: অর্থনীতির অন্যতম মৌলিক ধারণা হলো চাহিদা ও যোগান। চাহিদা বলতে ক্রেতারা একটি নির্দিষ্ট দামে কোনো পণ্য বা সেবা কেনার জন্য কতটা ইচ্ছুক তা বোঝায়। অন্যদিকে, যোগান বলতে বিক্রেতারা একটি নির্দিষ্ট দামে কতটা পণ্য সরবরাহ করতে প্রস্তুত তা বোঝায়। বাজার অর্থনীতির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই দুটি শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন চাহিদা বেশি থাকে এবং যোগান কম হয়, তখন মূল্য বৃদ্ধি পায়। আবার যখন যোগান বেশি থাকে এবং চাহিদা কম থাকে, তখন মূল্য হ্রাস পায়।
৫। মূল্যস্ফীতি ও মন্দা: মূল্যস্ফীতি ও মন্দা অর্থনীতির দুটি প্রধান সমস্যা। যখন সাধারণ দ্রব্য ও সেবার দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, তখন তাকে মূল্যস্ফীতি বলা হয়। এর ফলে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। অন্যদিকে, যখন একটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দীর্ঘ সময় ধরে কমে যায়, তখন তাকে মন্দা বলা হয়। মন্দার সময় বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদন হ্রাস পায়। এই দুটি পরিস্থিতিই একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
৬। জাতীয় আয়: জাতীয় আয় হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছরে) একটি দেশের সকল অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মোট মূল্য। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য পরিমাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর মধ্যে অন্যতম। জাতীয় আয় পরিমাপের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেমন মোট দেশজ উৎপাদন (GDP), মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) ইত্যাদি। জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলে সাধারণত দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় এবং সরকারের আয় বৃদ্ধি পায়।
৭। কর্মসংস্থান: কর্মসংস্থান অর্থনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা একটি দেশের শ্রমশক্তির দক্ষতা ও সক্ষমতা ব্যবহারের প্রতিফলন। এটি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, বরং সামাজিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করে। যখন একটি দেশে কর্মসংস্থানের হার বেশি থাকে, তখন বেকারত্বের হার কমে আসে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা সামগ্রিকভাবে বাজারে চাহিদা বাড়ায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটায়। উন্নত কর্মসংস্থান একটি শক্তিশালী অর্থনীতির প্রধান লক্ষণ।
৮। সরকারি বাজেট: সরকারি বাজেট হলো সরকারের আয় ও ব্যয়ের একটি বার্ষিক পরিকল্পনা। এই বাজেটের মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দ করে, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা এবং অবকাঠামো উন্নয়ন। সরকারি বাজেট একটি দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে, কারণ এটি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং মূল্যস্ফীতির উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। একটি সুপরিকল্পিত বাজেট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং সামাজিক অসমতা কমাতে সাহায্য করে।
উপসংহার: অর্থনীতি হলো একটি গতিশীল বিজ্ঞান যা আমাদের চারপাশে ঘটে চলা সমস্ত অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বুঝতে সাহায্য করে। এটি কেবল তত্ত্বীয় জ্ঞান নয়, বরং আমাদের বাস্তব জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও এটি অপরিহার্য। সম্পদ সীমিত, তাই এটিকে কীভাবে ব্যবহার করা হয় তা নির্ধারণ করে একটি জাতি কতটা উন্নত হবে। অর্থনীতি আমাদেরকে এই জটিল প্রক্রিয়াগুলোকে সহজভাবে বিশ্লেষণ করতে এবং কার্যকর নীতি প্রণয়ন করতে সাহায্য করে, যা একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য অপরিহার্য।
১। সীমিত সম্পদ ২। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ৩। উৎপাদন ও ভোগ ৪। চাহিদা ও যোগান ৫। মূল্যস্ফীতি ও মন্দা ৬। জাতীয় আয় ৭। কর্মসংস্থান ৮। সরকারি বাজেট।
১৯৩০-এর দশকের মহামন্দা ছিল বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে একটি বড় ধাক্কা, যা অনেক দেশের জিডিপিকে প্রায় ৫০% কমিয়ে দিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস “দি জেনারেল থিওরি অফ এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট অ্যান্ড মানি” বইটি প্রকাশ করেন ১৯৩৬ সালে, যা আধুনিক সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করে।

