- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা: মানুষের সমাজে অপরাধ ও বিচ্যুতি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। কেন কিছু কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং কারা বিচ্যুত আচরণকারী হিসেবে চিহ্নিত হন—এই প্রশ্ন সমাজবিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিন ধরে ভাবিয়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে হাওয়ার্ড বিকারের লেবেলিং তত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না, বরং সমাজের প্রতিক্রিয়া এবং আরোপিত লেবেলের মাধ্যমেই তা অপরাধের রূপ নেয়।
১.সামাজিক নির্মাণ (Social Construction): হাওয়ার্ড বিকার মনে করেন অপরাধ এবং বিচ্যুতি কোনো বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা নয়। বরং এগুলো সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া ধারণা। কোনো কাজ কখন এবং কেন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, তা সমাজের প্রভাবশালী গোষ্ঠী নির্ধারণ করে থাকে।
২.লেবেলিং প্রক্রিয়া (Labeling Process): বিকারের তত্ত্বের মূল ধারণা হলো লেবেলিং। যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সমাজ ‘অপরাধী’, ‘বিচ্যুত’ বা অন্য কোনো নেতিবাচক লেবেল প্রদান করে, তখন সেই লেবেল তাদের পরিচয় এবং আচরণকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। এই লেবেলিং প্রায়শই ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী কর্তৃক দুর্বল বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
৩.প্রাথমিক বিচ্যুতি (Primary Deviance): প্রাথমিক বিচ্যুতি হলো সেইসব ক্ষণস্থায়ী বা সামান্য নিয়মভঙ্গ যা ব্যক্তির আত্মপরিচয় বা সামাজিক ভূমিকার অংশ হয়ে ওঠে না। এই ধরনের আচরণ প্রায়শই ধরা পড়ে না বা তেমন গুরুত্ব পায় না। বিকার মনে করেন, প্রাথমিক বিচ্যুতি সমাজের স্বাভাবিক অংশ এবং এর মাধ্যমেই লেবেলিং প্রক্রিয়ার শুরু হতে পারে।
৪.মাধ্যমিক বিচ্যুতি (Secondary Deviance): যখন সমাজের লেবেলিং-এর প্রতিক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তি বিচ্যুত আচরণকে নিজের পরিচয় হিসেবে গ্রহণ করে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করতে শুরু করে, তখন তাকে মাধ্যমিক বিচ্যুতি বলা হয়। লেবেলের কারণে ব্যক্তিটি সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে এবং অপরাধী বা বিচ্যুত হিসেবে তার ভূমিকা আরও দৃঢ় হয়।
৫.আত্ম-পূরণকারী ভবিষ্যদ্বাণী (Self-fulfilling Prophecy): লেবেলিং প্রায়শই আত্ম-পূরণকারী ভবিষ্যদ্বাণীর জন্ম দেয়। যখন কোনো ব্যক্তিকে ক্রমাগত অপরাধী বা বিচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন সেই ব্যক্তি ধীরে ধীরে সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী আচরণ করতে শুরু করে। সমাজের নেতিবাচক ধারণা তার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয় এবং তাকে অপরাধের পথে ধাবিত করে।
৬.ক্ষমতার ভূমিকা (Role of Power): বিকারের তত্ত্বে ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সমাজের প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যেমন রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যম, কারা বিচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং কোন কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে তা নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দুর্বল বা সংখ্যালঘু গোষ্ঠী প্রায়শই অন্যায়ভাবে লেবেলের শিকার হয়।
৭.সামাজিক প্রতিক্রিয়া (Social Reaction): কোনো আচরণের প্রতি সমাজের প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করে সেই আচরণ বিচ্যুত হিসেবে গণ্য হবে কিনা। একই কাজ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট বয়সে মদ্যপান করা কোনো কোনো সমাজে স্বাভাবিক হলেও অন্য সমাজে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
৮.পরিচয় গঠন (Identity Formation): লেবেলিং ব্যক্তির আত্মপরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্রমাগত নেতিবাচক লেবেলের সম্মুখীন হলে ব্যক্তি নিজেকে সেই লেবেলের সাথে একাত্ম করে ফেলে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করতে শুরু করে। এর ফলে অপরাধী বা বিচ্যুত পরিচয় স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
৯.কলঙ্কিতকরণ: অপরাধী বা বিচ্যুত হিসেবে লেবেল লাগানোর ফলে ব্যক্তি stigmatized বা কলঙ্কিত হয়। এই কলঙ্ক সামাজিক জীবনে তার সুযোগ কমিয়ে দেয়, যেমন—চাকরি পাওয়া, বন্ধু তৈরি করা বা সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
১০.অপরাধের স্থিতিশীলতা (Stability of Crime): লেবেলিং তত্ত্ব অনুযায়ী, একবার কোনো ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে লেবেল পেলে সেই লেবেল সহজে মুছে যায় না। সমাজের নেতিবাচক ধারণা এবং প্রত্যাশা ব্যক্তিটিকে অপরাধের পথে ধরে রাখতে সাহায্য করে, যার ফলে অপরাধের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
১১.বিচার ব্যবস্থার প্রভাব (Impact of the Justice System): বিচার ব্যবস্থা লেবেলিং প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রেফতার, বিচার এবং কারাদণ্ডের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অপরাধী হিসেবে লেবেল দেওয়া হয়। এই আনুষ্ঠানিক লেবেলিং ব্যক্তির জীবনে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
১২.গণমাধ্যমের ভূমিকা (Role of Mass Media): গণমাধ্যম প্রায়শই অপরাধীদের এবং বিচ্যুতদের একটি নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরে। এর মাধ্যমে সমাজে একটি ধারণা তৈরি হয় এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ব্যক্তিদের প্রতি নেতিবাচক লেবেল আরও দৃঢ় হয়।
১৩.সাংস্কৃতিক ভিন্নতা (Cultural Differences): অপরাধ ও বিচ্যুতির ধারণা সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কোনো একটি সংস্কৃতিতে যা স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে গণ্য হতে পারে, অন্য সংস্কৃতিতে তা বিচ্যুত বা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। লেবেলিং প্রক্রিয়া এই সাংস্কৃতিক ভিন্নতার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
১৪.লেবেলের প্রভাবের সময়কাল (Duration of Label’s Impact): একটি নেতিবাচক লেবেলের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারামুক্ত হওয়ার পরেও একজন প্রাক্তন অপরাধীকে সমাজের সন্দেহ এবং নেতিবাচক দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয়, যা তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন করে তোলে।
১৫.পুনর্বাসনের প্রতিবন্ধকতা (Obstacles to Rehabilitation): লেবেলিং পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তোলে। সমাজের নেতিবাচক ধারণা এবং প্রত্যাশার কারণে প্রাক্তন অপরাধীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন।
১৬.নীতি নির্ধারণে প্রভাব (Influence on Policy Making): হাওয়ার্ড বিকারের লেবেলিং তত্ত্ব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং বিচার ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এই তত্ত্ব অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুনর্বাসনের গুরুত্বের উপর জোর দেয়।
১৭.গবেষণার ক্ষেত্র (Area of Research): লেবেলিং তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ক্ষেত্র। বিভিন্ন গবেষণা এই তত্ত্বের সত্যতা এবং প্রয়োগযোগ্যতা পরীক্ষা করে দেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০-এর দশকে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে অল্পবয়স্ক অপরাধীদের লেবেল দেওয়া হলে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।
১৮.সমালোচনা (Criticism): লেবেলিং তত্ত্ব কিছু সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এই তত্ত্ব ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি এবং অপরাধ করার সিদ্ধান্তের গুরুত্ব কমিয়ে দেখে। আবার কারো মতে, এটি কেবল সমাজের প্রতিক্রিয়ার উপর বেশি মনোযোগ দেয়, অপরাধের মূল কারণগুলো উপেক্ষা করে।
১৯.প্রয়োগ (Application): লেবেলিং তত্ত্ব কিশোর অপরাধ, মানসিক স্বাস্থ্য এবং মাদকাসক্তির মতো বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বুঝতে এবং সমাধানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। এই তত্ত্বের জ্ঞান ব্যবহার করে এমন নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব যা লেবেলিং-এর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।
২০.বিকল্প ব্যাখ্যা (Alternative Explanations): অপরাধ ও বিচ্যুতির আরও অনেক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রয়েছে, যেমন—স্ট্রেইন তত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব এবং সামাজিক শিক্ষার তত্ত্ব। লেবেলিং তত্ত্ব এই অন্যান্য ব্যাখ্যাগুলোর পরিপূরক হিসেবে কাজ করে এবং অপরাধের একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে।
২১.সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিকতা (Contemporary Relevance): আধুনিক সমাজে, বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লেবেলিং-এর প্রভাব নতুন মাত্রা লাভ করেছে। সাইবার বুলিং এবং অনলাইন হ্যারেজমেন্টের মাধ্যমে ব্যক্তিদের দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে লেবেল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, যার দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক পরিণতি হতে পারে।
উপসংহার: হাওয়ার্ড বিকারের লেবেলিং তত্ত্ব অপরাধ ও বিচ্যুতির সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই তত্ত্ব আমাদের দেখায় যে কীভাবে সমাজের প্রতিক্রিয়া এবং আরোপিত লেবেল কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী বা বিচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত করতে এবং সেই ভূমিকা বজায় রাখতে সাহায্য করে। লেবেলিং-এর নেতিবাচক প্রভাব উপলব্ধি করে একটি সহানুভূতিশীল এবং পুনর্বাসনমুখী সমাজ গঠনে এই তত্ত্ব সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
সামাজিক নির্মাণ, লেবেলিং প্রক্রিয়া, প্রাথমিক বিচ্যুতি, মাধ্যমিক বিচ্যুতি, আত্ম-পূরণকারী ভবিষ্যদ্বাণী, ক্ষমতার ভূমিকা, সামাজিক প্রতিক্রিয়া, পরিচয় গঠন, stigmatization, অপরাধের স্থিতিশীলতা, বিচার ব্যবস্থার প্রভাব, গণমাধ্যমের ভূমিকা, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, লেবেলের প্রভাবের সময়কাল, পুনর্বাসনের প্রতিবন্ধকতা, নীতি নির্ধারণে প্রভাব, গবেষণার ক্ষেত্র, সমালোচনা, প্রয়োগ, বিকল্প ব্যাখ্যা, সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিকতা।
বিকারের লেভেলিং তত্ত্ব ১৯৬০-এর দশকে সমাজবিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। তার গবেষণায় অনেক জরিপ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেমন ‘ডেভিড ম্যাটজ’ এর ১৯৬১ সালের গবেষণা, যা লেবেলিংয়ের প্রভাবের উপর ফোকাস করেছিল। এই তত্ত্ব মূলত সামাজিক আচরণ ও অপরাধের বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।