- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অবাধ বাণিজ্য (Free Trade) এবং সংরক্ষণ বাণিজ্য (Protectionism) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দুটি ভিন্ন নীতি। অবাধ বাণিজ্যে সরকার ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করে, যার ফলে পণ্য ও সেবা সহজে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলাচল করতে পারে। অন্যদিকে, সংরক্ষণ বাণিজ্যে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে সরকার বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই দুটি নীতির ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই তাদের মূল পার্থক্য।
১।মুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার: অবাধ বাণিজ্যের মূল লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবা অবাধে চলাচল করতে দেওয়া, যেখানে কোনো শুল্ক, কোটা বা অন্য কোনো সরকারি বাধা থাকে না। এর ফলে, এক দেশের উৎপাদিত পণ্য অন্য দেশে সহজে এবং কম খরচে বিক্রি করা যায়। এটি মূলত মুক্ত প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে, যা ভোক্তা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য উপকারী। অন্যদিকে, সংরক্ষণ বাণিজ্যের মূল উদ্দেশ্য হলো দেশীয় বাজারকে বিদেশী পণ্যের প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করা।
২।সরকারি হস্তক্ষেপের ভূমিকা: অবাধ বাণিজ্য নীতিতে সরকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করে না। এখানে বাজার তার নিজস্ব চাহিদা ও সরবরাহের নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এই নীতির প্রবক্তারা মনে করেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া বাজার আরও দক্ষ ও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে। এর বিপরীতে, সংরক্ষণ বাণিজ্যে সরকার বিভিন্ন ধরনের শুল্ক, কোটা, ভর্তুকি, এবং অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বিদেশী পণ্যের প্রবেশ সীমিত করে দেয়।
৩।ভোক্তার সুবিধা: অবাধ বাণিজ্যের একটি বড় সুবিধা হলো এটি ভোক্তাদের জন্য উপকারী। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ফলে বাজারে পণ্যের দাম কমে এবং গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। ভোক্তারা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পণ্য বেছে নিতে পারে, যা তাদের পছন্দ ও ক্রয়ক্ষমতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সংরক্ষণ বাণিজ্যের কারণে বাজারে বিদেশী পণ্যের সরবরাহ সীমিত হয়, যার ফলে দেশীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ভোক্তাদের পছন্দের সুযোগ কমে যায়।
৪।শুল্ক ও কোটা: অবাধ বাণিজ্য ব্যবস্থায় কোনো প্রকার শুল্ক বা কোটা থাকে না, যার ফলে পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কোনো কর আরোপ করা হয় না। এর ফলে আমদানি ও রপ্তানি সহজ হয় এবং পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে। সংরক্ষণ বাণিজ্যে সরকার বিদেশী পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর (শুল্ক) আরোপ করে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্যের (কোটা) আমদানি সীমিত করে দেয়। এই শুল্ক ও কোটা দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
৫।প্রতিযোগিতার পরিবেশ: অবাধ বাণিজ্য দেশীয় শিল্পকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি করে। এর ফলে, দেশীয় শিল্পগুলো নিজেদের দক্ষতা ও মান বাড়াতে বাধ্য হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের উন্নয়নে সহায়তা করে। এটি উদ্ভাবনকেও উৎসাহিত করে। সংরক্ষণ বাণিজ্য নীতি দেশীয় শিল্পকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে দূরে রাখে, যা তাদের অলস করে তুলতে পারে এবং পণ্যের গুণগত মান বা উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।
৬।অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অবাধ বাণিজ্য অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আনতে পারে কারণ এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে নতুন বাজার তৈরি করে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি করে। এর ফলে, দেশীয় শিল্পগুলো বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের অংশ হতে পারে। সংরক্ষণ বাণিজ্য কিছু ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করলেও, এটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, কারণ এটি বৈশ্বিক বাজারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে এবং সীমিত সুযোগ সৃষ্টি করে।
৭।কর্মসংস্থানের প্রভাব: অবাধ বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ফলে কিছু অদক্ষ বা দুর্বল দেশীয় শিল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার ফলে স্বল্পমেয়াদে কর্মসংস্থান হ্রাস পেতে পারে। তবে, দীর্ঘমেয়াদে দক্ষ শিল্পগুলো উন্নত হয়ে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। সংরক্ষণ বাণিজ্য স্বল্পমেয়াদে দেশীয় শিল্পগুলোকে রক্ষা করে কর্মসংস্থান বজায় রাখে, কিন্তু এটি বৈশ্বিক বাজারে নতুন সুযোগ সৃষ্টিতে বাধা দেয় এবং কর্মসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনাকে সীমিত করে।
৮।সম্পদের ব্যবহার: অবাধ বাণিজ্য দেশগুলোকে সেইসব পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করে যেখানে তাদের তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে। অর্থাৎ, যে দেশ যে পণ্য সবচেয়ে ভালোভাবে এবং কম খরচে উৎপাদন করতে পারে, সে সেই পণ্য উৎপাদন করে। এর ফলে, বিশ্বের মোট সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয়। সংরক্ষণ বাণিজ্য এই নীতিকে বাধা দেয়, যার ফলে দেশগুলো অদক্ষভাবে সম্পদ ব্যবহার করে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির দক্ষতা কমে যায়।
৯।দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা: সংরক্ষণ বাণিজ্যের একটি প্রধান যুক্তি হলো এটি নবীন বা দুর্বল দেশীয় শিল্পগুলোকে শক্তিশালী হতে সময় দেয়। নতুন কোনো শিল্প যখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়, তখন সে টিকে থাকতে পারে না, তাই তাকে সুরক্ষা দেওয়া হয়। অবাধ বাণিজ্য নীতিতে এই ধরনের সুরক্ষা দেওয়া হয় না। এর ফলে নতুন শিল্পগুলো সহজে প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে যায়, যা তাদের টিকে থাকাকে কঠিন করে তোলে।
১০।মূল্যের উপর প্রভাব: অবাধ বাণিজ্যের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ে, যার ফলে পণ্যের দাম কমে যায়। ভোক্তারা কম দামে ভালো পণ্য কেনার সুযোগ পায়। সংরক্ষণ বাণিজ্যের ফলে শুল্ক ও কোটার কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। দেশীয় পণ্যের মূল্যও বেড়ে যায়, কারণ আন্তর্জাতিক পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার অভাব থাকে।
১১।বৈশ্বিক সম্পর্ক: অবাধ বাণিজ্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বাড়ায়, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে উন্নত করতে পারে। এটি অর্থনৈতিক জোট ও চুক্তিকে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে, সংরক্ষণ বাণিজ্য প্রায়শই আন্তর্জাতিক উত্তেজনা ও বাণিজ্য যুদ্ধ সৃষ্টি করে। একটি দেশ যখন অন্য দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে, তখন অন্য দেশও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, যা বৈশ্বিক সম্পর্ককে খারাপ করে।
১২।উদ্ভাবন ও দক্ষতা: অবাধ বাণিজ্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উদ্ভাবন ও দক্ষতা বাড়াতে উৎসাহিত করে। দেশীয় কোম্পানিগুলো টিকে থাকার জন্য নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। এর ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি উন্নত হয়। সংরক্ষণ বাণিজ্য দেশীয় শিল্পগুলোকে প্রতিযোগিতার চাপ থেকে মুক্ত রাখে, ফলে তারা নতুনত্ব বা দক্ষতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।
১৩।বাজারের আকার: অবাধ বাণিজ্য দেশীয় কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে সহায়তা করে, যা তাদের বাজারের আকার বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে তারা আরও বড় পরিসরে উৎপাদন করতে পারে, যা অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সংরক্ষণ বাণিজ্য দেশীয় কোম্পানিগুলোকে শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরে সীমিত রাখে, যা তাদের বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে সীমিত করে।
১৪।তুলনামূলক সুবিধা: অবাধ বাণিজ্য তুলনামূলক সুবিধার নীতিকে সমর্থন করে, যেখানে দেশগুলো যে পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে দক্ষ, সেগুলোর ওপর মনোযোগ দেয়। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির দক্ষতা বাড়ায়। সংরক্ষণ বাণিজ্য এই নীতিকে উপেক্ষা করে, যার ফলে দেশগুলো এমন পণ্য উৎপাদন করে যেখানে তাদের কোনো বিশেষ দক্ষতা নেই, যা অদক্ষতার জন্ম দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবাধ বাণিজ্য (free trade) এবং সংরক্ষণ বাণিজ্যের (protectionism) মধ্যে কোনটি বেশি উপযোগী, তা একটি জটিল প্রশ্ন।
অবাধ বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে সহজে প্রবেশ করতে পারে, যা রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এবং পণ্যের বৈচিত্র্য ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে। তবে, অবাধ বাণিজ্য দেশের স্থানীয় শিল্পগুলোকে প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে, যার ফলে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অন্যদিকে, সংরক্ষণ বাণিজ্য স্থানীয় শিল্পগুলোকে বিদেশী প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা করে। এটি নতুন শিল্প গড়ে তুলতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করে। কিন্তু এর ফলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে এবং বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার সীমিত হতে পারে, যা রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য, একটি সুষম পন্থা (balanced approach) সবচেয়ে উপযোগী। প্রথমে কিছু নির্দিষ্ট শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া যেতে পারে, যেন তারা বিদেশি প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হতে পারে। এরপর ধীরে ধীরে অবাধ বাণিজ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে সংহতি নিশ্চিত করবে।
উপসংহার: অবাধ বাণিজ্য এবং সংরক্ষণ বাণিজ্য দুটি ভিন্ন অর্থনৈতিক দর্শন। অবাধ বাণিজ্য মুক্ত বাজার, প্রতিযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ভোক্তার সুবিধার জন্য উপকারী হতে পারে। অন্যদিকে, সংরক্ষণ বাণিজ্য দেশীয় শিল্প, কর্মসংস্থান এবং নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দেয়, যা স্বল্পমেয়াদে দেশের জন্য উপকারী হতে পারে। উভয় নীতিরই নিজস্ব সুবিধা ও অসুবিধা আছে, এবং কোনো দেশের জন্য কোন নীতি সবচেয়ে উপযুক্ত তা নির্ভর করে সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, শিল্প কাঠামো এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যের ওপর।
🌎 মুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার 💰 সরকারি হস্তক্ষেপের ভূমিকা 🛍️ ভোক্তার সুবিধা 🚫 শুল্ক ও কোটা ⚔️ প্রতিযোগিতার পরিবেশ 📈 অর্থনৈতিক উন্নয়ন 💼 কর্মসংস্থানের প্রভাব ⚙️ সম্পদের ব্যবহার 🛡️ দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা 💵 মূল্যের উপর প্রভাব 🤝 বৈশ্বিক সম্পর্ক 🔬 উদ্ভাবন ও দক্ষতা 🌍 বাজারের আকার ⚖️ তুলনামূলক সুবিধা।
অবাধ বাণিজ্য ও সংরক্ষণ বাণিজ্যের বিতর্ক নতুন নয়। ১৯শ শতাব্দীর দিকে ডেভিড রিকার্ডো-এর তুলনামূলক সুবিধার তত্ত্ব অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি তৈরি করে। অন্যদিকে, আলেকজান্ডার হ্যামিলটন-এর মতো চিন্তাবিদরা সংরক্ষণ বাণিজ্যকে নতুন শিল্প রক্ষার জন্য জরুরি বলে মনে করেন। ১৯৩০-এর দশকের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর সময় বিশ্বজুড়ে সংরক্ষণ বাণিজ্য ব্যাপক আকার ধারণ করে, যখন দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতি রক্ষার জন্য উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর প্রতিক্রিয়ায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গ্যাট (GATT)’ বা ‘ট্যারিফ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ চুক্তি’, যার লক্ষ্য ছিল শুল্ক হ্রাস করে অবাধ বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা। ১৯৯৫ সালে গ্যাট-এর স্থলাভিষিক্ত হয় ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)’, যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মকানুন তৈরি ও বাস্তবায়ন করে। বিভিন্ন জরিপ দেখায় যে অবাধ বাণিজ্যের কারণে বৈশ্বিক দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, তবে কিছু দেশ এর কারণে অসম প্রতিযোগিতার শিকার হয়েছে।

