- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনৈতিক লেনদেন এবং আধুনিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো অর্থ। এটি শুধু কাগজের নোট বা ধাতব মুদ্রা নয়, বরং একটি শক্তিশালী মাধ্যম যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে গতিশীল করে তোলে। অর্থ ছাড়া আমাদের সমাজের বাণিজ্যিক কার্যক্রম, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব। অর্থ তার বিভিন্ন কার্যাবলির মাধ্যমে মানবসভ্যতাকে একটি সুসংগঠিত এবং গতিশীল রূপ দিয়েছে। নিচে অর্থের প্রধান কার্যাবলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১। বিনিময়ের মাধ্যম: অর্থ হলো বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম যা পণ্য ও সেবা কেনা-বেচাকে সহজ করে তোলে। প্রাচীনকালে মানুষ যখন দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্য আদান-প্রদান করত, তখন এই ব্যবস্থায় নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিত। উদাহরণস্বরূপ, একজন কৃষক যখন তার উৎপাদিত শস্যের বিনিময়ে একজন কামারের তৈরি লোহার জিনিসপত্র নিতে চাইত, তখন উভয়ের চাহিদা এবং পণ্যের মূল্যের সঠিক সমন্বয় করা কঠিন ছিল। কিন্তু অর্থের প্রচলন সেই সমস্যা দূর করেছে। এখন আমরা অর্থ দিয়ে যেকোনো পণ্য বা সেবা সহজেই কিনতে পারি, যা বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে অনেক সহজ ও দ্রুত করেছে।
২। মূল্যের পরিমাপক: অর্থ যেকোনো পণ্য বা সেবার মূল্য নির্ধারণের একটি সাধারণ মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ধরনের পণ্য বা সেবার মূল্যকে অর্থের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, যা তুলনামূলক বিশ্লেষণকে সহজ করে। ধরা যাক, একটি বই, একটি কলম এবং একটি টি-শার্টের মূল্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কিন্তু অর্থের মাধ্যমে আমরা তাদের মূল্যকে একটি নির্দিষ্ট এককে প্রকাশ করতে পারি। এর ফলে, আমরা সহজেই বুঝতে পারি কোন জিনিসের মূল্য কত এবং এর বিনিময়ে কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন। এটি অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অপরিহার্য।
৩। মূল্যের ভান্ডার: অর্থ সম্পদ সঞ্চয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। মানুষ তাদের উপার্জিত অর্থ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে পারে। এটি একটি স্থিতিশীল রূপ যা সহজে নষ্ট হয় না এবং যার মূল্য দীর্ঘমেয়াদে বজায় থাকে। যদিও মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থের মূল্য কিছুটা কমতে পারে, তবুও এটি অন্য অনেক সম্পদের (যেমন – শাকসবজি বা ফলমূল) চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল। মানুষ অর্থ সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের প্রয়োজন, যেমন – সন্তানের শিক্ষা, বাড়ি কেনা বা যেকোনো জরুরি অবস্থার জন্য ব্যবহার করতে পারে। এই ক্ষমতা অর্থকে একটি নির্ভরযোগ্য সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
৪। ঋণ পরিশোধের মান: অর্থ ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ মান হিসেবে কাজ করে। যখন একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেয়, তখন সেই ঋণের পরিমাণ অর্থের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয়। এটি ঋণদাতা এবং ঋণগ্রহীতা উভয়ের জন্যই সুবিধা নিয়ে আসে, কারণ ঋণের শর্তাবলি পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। ভবিষ্যতে যখন ঋণ পরিশোধের সময় আসে, তখন সেই অর্থ দ্বারাই ঋণ পরিশোধ করা হয়। এই ব্যবস্থা বাণিজ্যিক এবং আর্থিক লেনদেনকে সুশৃঙ্খল করে এবং আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।
৫। তারল্য সরবরাহ: অর্থ তারল্যের একটি চূড়ান্ত রূপ। তারল্য বলতে বোঝায় কোনো সম্পদকে কত সহজে নগদ অর্থে রূপান্তর করা যায়। অর্থ নিজেই নগদ হওয়ায় এটি সবচেয়ে বেশি তারল্যযুক্ত সম্পদ। এই বৈশিষ্ট্য অর্থের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক, কারণ এর ফলে যেকোনো জরুরি অবস্থায় দ্রুত অর্থ ব্যবহার করা সম্ভব হয়। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন তাৎক্ষণিক কোনো খরচ মেটাতে চায়, তখন তারা সহজেই তাদের হাতে থাকা অর্থ ব্যবহার করতে পারে। এই তারল্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা এবং গতিশীলতা বজায় রাখে।
৬। লেনদেন সহজকরণ: আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি হলো অর্থ, যা সব ধরনের লেনদেনকে সহজ করে তোলে। এটি শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, শেয়ার বাজার এবং অন্যান্য আর্থিক বাজারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হয়, কারণ এটি বিভিন্ন দেশের মধ্যে মূল্য নির্ধারণের একটি সাধারণ ভিত্তি প্রদান করে। বিভিন্ন আর্থিক উপকরণ, যেমন – চেক, ডেবিট কার্ড এবং ক্রেডিট কার্ড অর্থের এই লেনদেন সহজ করার ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
৭। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অর্থকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ায় বা কমায়, তখন তার প্রভাব সুদের হার, বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে দেখা যায়। এই ভূমিকা অর্থকে একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে।
৮। আর্থিক সঞ্চয়: অর্থ শুধু একটি ভান্ডার হিসেবেই কাজ করে না, বরং আর্থিক সঞ্চয়কে উৎসাহিত করে। মানুষ যখন তাদের আয় থেকে কিছু অংশ সঞ্চয় করে, তখন সেই অর্থ ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা হয়। এই সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকগুলো আবার ঋণ হিসেবে প্রদান করে, যা বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়। এভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে সঞ্চিত অর্থ সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সঞ্চয় প্রক্রিয়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
উপসংহার: অর্থের এই বহুবিধ কার্যাবলি আমাদের আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সুসংহত ও শক্তিশালী করেছে। এটি শুধু বিনিময়ের মাধ্যম নয়, বরং মূল্য পরিমাপ, সঞ্চয় এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। অর্থের এই কার্যাবলি সম্পর্কে বোঝা আমাদের দৈনন্দিন আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
- বিনিময়ের মাধ্যম
- মূল্যের পরিমাপক
- মূল্যের ভান্ডার
- ঋণ পরিশোধের মান
- তারল্য সরবরাহ
- লেনদেন সহজকরণ
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
- আর্থিক সঞ্চয়
কাগজের মুদ্রার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। চীনা হান রাজবংশের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে খ্রিস্টাব্দ ২২০) চামড়ার নোটের প্রচলন ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রথম দিকে, কাগজের মুদ্রা ১১শ শতাব্দীর দিকে চীনের গান রাজবংশের সময় (৯৬০-১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ) সরকারিভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এরপর, ১৬৬১ সালে সুইডেনে ইউরোপের প্রথম ব্যাংক নোট চালু হয়। পরবর্তীতে, আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রসারের সাথে সাথে অর্থ ও এর ব্যবহারিক রূপ পরিবর্তিত হয়ে আরও সুসংগঠিত হয়েছে। আধুনিক ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থাও অর্থের কার্যাবলিকে আরো গতিশীল করেছে।

