- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থ সরবরাহ বা মানি সাপ্লাই হলো অর্থনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ মুদ্রা বা তার সমতুল্য সম্পদ রয়েছে তা বোঝায়। এটি কেবল কাগজের টাকা বা ধাতব মুদ্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যাংক আমানত, বন্ড এবং অন্যান্য আর্থিক উপকরণও এর অন্তর্ভুক্ত। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক এই অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে, যা মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। সহজ কথায়, একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলো এই অর্থ সরবরাহ, যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সাহায্য করে।
১। কাগজের মুদ্রা ও ধাতব কয়েন: অর্থ সরবরাহের সবচেয়ে দৃশ্যমান এবং মৌলিক উপাদান হলো কাগজের মুদ্রা ও ধাতব কয়েন, যা সাধারণত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার দ্বারা জারি করা হয়। এই ধরনের অর্থকে নগদ অর্থ বলা হয় এবং এটি জনগণের হাতে সরাসরি লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়। দৈনন্দিন কেনাকাটা, ছোটখাটো লেনদেন এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রমে এই নগদ অর্থের ব্যবহার অপরিহার্য। এটি সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়বদ্ধতা এবং যেকোনো আর্থিক ব্যবস্থায় এর ভূমিকা অপরিসীম।
২। ব্যাংক আমানত: এটি অর্থ সরবরাহের সবচেয়ে বড় অংশ এবং অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। মানুষের সঞ্চয় ও লেনদেন ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের আমানতের মাধ্যমে জমা থাকে, যেমন চলতি হিসাব, সঞ্চয়ী হিসাব এবং মেয়াদী হিসাব। এই আমানতগুলো ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের জন্য ব্যবহার করে, যা অর্থনীতিতে নতুন অর্থের সৃষ্টি করে। ব্যাংক আমানত হলো নগদ অর্থের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী একটি উপাদান, কারণ এর মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ ও ক্রেডিট তৈরি করে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল রাখে।
৩। ঋণ ও ক্রেডিট: ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন ব্যক্তি বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়, তখন নতুন অর্থের সৃষ্টি হয়। এই ঋণগুলো ক্রেডিট কার্ড, ব্যক্তিগত ঋণ, বা ব্যবসায়িক ঋণের মাধ্যমে দেওয়া হতে পারে। এই ঋণের মাধ্যমে গ্রাহক এমন জিনিস কিনতে পারে যা কেনার জন্য তার কাছে নগদ টাকা নেই, ফলে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি ঋণ আসলে এক ধরনের নতুন অর্থের সৃষ্টি, যা সামগ্রিক অর্থ সরবরাহে যোগ হয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে।
৪। সরকারি বন্ড: সরকারি বন্ড হলো সরকারের দ্বারা জারি করা এক ধরনের ঋণপত্র, যা সরকার জনগণের কাছ থেকে অর্থ ধার করার জন্য ব্যবহার করে। যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বন্ড কেনে, তখন সে সরকারকে ঋণ দেয় এবং সরকার সেই অর্থ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করে। এই বন্ডগুলো বাজারে বিক্রি হয় এবং তারল্য সৃষ্টি করে, যা অর্থ সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যখন সরকার বন্ড বিক্রি করে, তখন অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাণ্ডারে জমা হয়, আর যখন সরকার তা পুনরায় ক্রয় করে, তখন অর্থ অর্থনীতিতে ফিরে আসে।
৫। বিদেশি মুদ্রা: কোনো দেশের অর্থ সরবরাহে বিদেশি মুদ্রার একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে যখন কোনো দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জড়িত থাকে। রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বিদেশি মুদ্রা যখন দেশে প্রবেশ করে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে রূপান্তরিত হয়, তখন তা দেশের অর্থ সরবরাহে যোগ হয়। একইভাবে, আমদানি বা বিদেশি বিনিয়োগের কারণে বিদেশি মুদ্রা যখন দেশ থেকে বের হয়ে যায়, তখন তা অর্থ সরবরাহ হ্রাস করে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
৬। রেপো রেট: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদের হারে ঋণ দেয়, তাকে রেপো রেট বা রেপোর্চেজ রেট বলা হয়। এই রেট অর্থ সরবরাহের একটি পরোক্ষ কিন্তু শক্তিশালী উপাদান। যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো রেট বাড়িয়ে দেয়, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণ নেওয়া ব্যয়বহুল হয়ে যায়, ফলে তারা কম ঋণ দেয় এবং অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ কমে যায়। এর উল্টোটা ঘটলে অর্থ সরবরাহ বাড়ে। তাই রেপো রেটকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ধরা হয়।
৭। ওপেন মার্কেট অপারেশন: এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি কৌশল, যেখানে তারা বাজারে সরকারি বন্ড কেনা বা বিক্রি করে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ড বিক্রি করে, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা অর্থ কমে যায়, যা অর্থ সরবরাহকে সংকুচিত করে। অন্যদিকে, যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ড কেনে, তখন ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ অর্থ বেড়ে যায় এবং অর্থ সরবরাহ প্রসারিত হয়। এই পদ্ধতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায়শই তার মুদ্রানীতি কার্যকর করার জন্য ব্যবহার করে।
৮। সংরক্ষিত তহবিলের অনুপাত: বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তাদের মোট আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হয়, যাকে সংরক্ষিত তহবিলের অনুপাত বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অনুপাত বাড়িয়ে দিলে ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ দেওয়ার জন্য কম অর্থ থাকে, ফলে অর্থ সরবরাহ কমে যায়। এর উল্টোটা হলে অর্থ সরবরাহ বাড়ে। এটি একটি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ সরবরাহের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ব্যবহার করে।
উপসংহার: অর্থ সরবরাহ বা মানি সাপ্লাই কোনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এই উপাদানগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত এবং সম্মিলিতভাবে একটি দেশের আর্থিক কাঠামোকে সুসংহত করে। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য অর্থ সরবরাহের সঠিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই উপাদানগুলো ব্যবহার করে তাদের মুদ্রানীতি কার্যকর করে, যা একটি দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
- কাগজের মুদ্রা ও ধাতব কয়েন
- ব্যাংক আমানত
- ঋণ ও ক্রেডিট
- সরকারি বন্ড
- বিদেশি মুদ্রা
- রেপো রেট
- ওপেন মার্কেট অপারেশন
- সংরক্ষিত তহবিলের অনুপাত
অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান ১৯৬৩ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ “A Monetary History of the United States, 1867-1960” এ দেখিয়েছেন যে, অর্থ সরবরাহের পরিবর্তন মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ। ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ সরবরাহের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, যা ফেডারেল রিজার্ভকে কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণে বাধ্য করে। এছাড়া, ১৯৯৭ সালের এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাওয়ায় দেশগুলোর অর্থ সরবরাহ সংকুচিত হয়, যা অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনে।

