- readaim.com
- 0

উত্তর::প্রাককথা:- মানব সমাজের জটিল শাসনব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা পর্যন্ত, এই ব্যবস্থার প্রভাব সর্বত্র বিস্তৃত। একটি সুসংগঠিত এবং কার্যকর আমলাতন্ত্র একটি দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের চাবিকাঠি হতে পারে। তবে এর কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচনার অবকাশ রাখে। আসুন, সহজ ভাষায় আমলাতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১. পদসোপানভিত্তিক সংগঠন: আমলাতন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর স্তরভিত্তিক কাঠামো। এখানে প্রতিটি পদ একটি নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের অধীনে বিন্যস্ত থাকে। সর্বনিম্ন স্তর থেকে ধাপে ধাপে উচ্চতর পদে কর্মকর্তারা পদোন্নতি লাভ করেন। এই কাঠামোয় ক্ষমতার একটি সুস্পষ্ট বিন্যাস দেখা যায়, যেখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধস্তনদের নির্দেশ দেন এবং তাদের কাজের তত্ত্বাবধান করেন। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার এই পদসোপানকে আমলাতন্ত্রের একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
২. বিশেষায়িত শ্রম ও কার্যবিভাজন: আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর্মীদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কার্যাবলী বণ্টন করা হয়। প্রত্যেক কর্মী তাদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে বিশেষায়িত কাজ সম্পাদন করেন। এই কার্যবিভাজনের ফলে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং নির্দিষ্ট কাজ দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সরকারি অফিসের বিভিন্ন বিভাগে আলাদা আলাদা কর্মকর্তারা ভূমি সংক্রান্ত কাজ, আর্থিক বিষয়াবলী বা প্রশাসনিক কাজকর্মের মতো বিশেষায়িত দায়িত্ব পালন করেন।
৩. আনুষ্ঠানিক নিয়ম ও পদ্ধতি: আমলাতন্ত্রের কার্যক্রম সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন ও পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রতিটি কাজের জন্য আগে থেকে নির্ধারিত নীতিমালা ও প্রোটোকল অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। এই আনুষ্ঠানিক নিয়মাবলী ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালখুশির পরিবর্তে একটি ধারাবাহিক ও নিরপেক্ষ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামঞ্জস্য বজায় থাকে এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ হ্রাস পায়।
৪. নথিভিত্তিক কার্যক্রম: আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম লিখিত নথির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়। মৌখিক নির্দেশের পরিবর্তে লিখিত যোগাযোগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই নথি ভবিষ্যতের জন্য প্রমাণ হিসেবে কাজ করে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়। কোনো বিষয়ে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এই নথিগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. পেশাদারিত্ব ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ: আমলাতন্ত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়া সাধারণত মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের নির্বাচন করা হয়। এর ফলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তিরা সরকারি পদে নিযুক্ত হন এবং পেশাদারিত্বের একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
৬. স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা: আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় নিযুক্ত সরকারি কর্মচারীরা সাধারণত দীর্ঘ কর্মজীবন লাভ করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও তাদের পদে তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। এই স্থায়িত্ব সরকারের নীতি ও কর্মসূচির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৭. কর্তৃত্ব ও আনুগত্য: আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অধস্তন কর্মকর্তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। এই কর্তৃত্ব ও আনুগত্যের সম্পর্ক প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অপরিহার্য।
৮. অব্যক্তিক সম্পর্ক: আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে দাপ্তরিক সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে আইন ও বিধি অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালন করেন এবং ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের ঊর্ধ্বে থাকেন।
৯. রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা: আদর্শ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীরা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকেন। তারা দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে সরকার কর্তৃক প্রণীত নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
১০. জনগণের সেবার মনোভাব: যদিও সমালোচকরা আমলাতন্ত্রকে কাঠখোট্টা ও জনবিচ্ছিন্ন বলে মনে করেন, এর মূল উদ্দেশ্য জনগণের সেবা করা। সরকারি কর্মচারীরা জনগণের চাহিদা পূরণ এবং তাদের কল্যাণে কাজ করার জন্য নিয়োজিত থাকেন।
১১. আইনের শাসন: আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সকল কার্যক্রম আইন ও সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়। এর ফলে স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সীমিত হয়ে আসে।
১২. বৃহত্তর কর্মপরিধি: আধুনিক রাষ্ট্রের কর্মপরিধি ব্যাপক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, যোগাযোগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রের এই বহুমাত্রিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র অপরিহার্য।চ
১৩. নীতি বাস্তবায়ন: সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের প্রধান দায়িত্বও আমলাতন্ত্রের উপর ন্যস্ত থাকে। মাঠ পর্যায়ে সরকারি কর্মসূচি পৌঁছে দেওয়া এবং তার সফল রূপায়ণ আমলাদের মাধ্যমেই সম্ভব হয়।
১৪. তথ্য ও জ্ঞানের ভান্ডার: আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর্মরত দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান জ্ঞান ও তথ্যের অধিকারী হন। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৫. জবাবদিহিতা: যদিও আমলাতন্ত্রে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ রয়েছে, একটি কার্যকর ব্যবস্থায় কর্মকর্তাদের তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে জনগণের কাছেও তাদের কাজের ব্যাখ্যা দিতে হয়।
১৬. পরিবর্তনশীলতার অভাব: অনেক সময় আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় নতুন ধারণা ও পরিবর্তনের বিরোধিতা দেখা যায়। দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও পদ্ধতির প্রতি অনীহা নতুনত্ব গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
১৭. লাল ফিতার দৌরাত্ম্য: আমলাতন্ত্রের একটি বহুল আলোচিত সমালোচনা হলো লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতা ও জটিল প্রক্রিয়ার কারণে অনেক সময় সাধারণ মানুষ সরকারি সেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হন।
১৮. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব: স্তরভিত্তিক কাঠামো ও আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির কারণে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা হতে পারে।
১৯. দুর্নীতির সম্ভাবনা: ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতি ধারণাসূচক সূচক (Corruption Perception Index) বিভিন্ন দেশের আমলাতন্ত্রে দুর্নীতির মাত্রা সম্পর্কে ধারণা দেয়।
২০. জনগণের সাথে দূরত্ব: অনেক সময় আমলাতান্ত্রিক কর্মকর্তারা নিজেদেরকে জনগণের থেকে আলাদা মনে করেন এবং সাধারণ মানুষের সমস্যা ও চাহিদা সম্পর্কে যথেষ্ট সংবেদনশীল হন না বলে অভিযোগ ওঠে। এর ফলে জনগণ ও সরকারের মধ্যে একটি দূরত্ব তৈরি হতে পারে।
২১. প্রযুক্তির ব্যবহারে অনীহা: কিছু ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন প্রযুক্তি ও আধুনিকীকরণের প্রতি অনীহা দেখা যায়। সনাতনী পদ্ধতির উপর অধিক নির্ভরতা কর্মদক্ষতা কমিয়ে আনতে পারে। তবে বর্তমানে অনেক দেশেই ই-গভর্নেন্সের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রকে আরও আধুনিক ও জনবান্ধব করার প্রচেষ্টা চলছে।
উপসংহার:- আমলাতন্ত্র একটি জটিল ব্যবস্থা, যার যেমন কিছু অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তেমনি কিছু দুর্বলতাও বিদ্যমান। একটি কার্যকর ও জনমুখী আমলাতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দক্ষতা এবং জনগণের প্রতি সেবার মানসিকতা। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমলাতন্ত্রকে আরও গতিশীল ও আধুনিক করে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
প্রশ্নটির উত্তরে একের অধিক অংশ থাকলে এই অংশটি ব্যবহার করুন।
একনজরে আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ:
পদসোপানভিত্তিক সংগঠন, বিশেষায়িত শ্রম ও কার্যবিভাজন, আনুষ্ঠানিক নিয়ম ও পদ্ধতি, নথিভিত্তিক কার্যক্রম, পেশাদারিত্ব ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ, স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা, কর্তৃত্ব ও আনুগত্য, অব্যক্তিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, জনগণের সেবার মনোভাব, আইনের শাসন, বৃহত্তর কর্মপরিধি, নীতি বাস্তবায়ন, তথ্য ও জ্ঞানের ভান্ডার, জবাবদিহিতা, পরিবর্তনশীলতার অভাব, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব, দুর্নীতির সম্ভাবনা, জনগণের সাথে দূরত্ব, প্রযুক্তির ব্যবহারে অনীহা।
আমলাতন্ত্রের ধারণা প্রথম প্রণয়ন করেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার। তার মতে, আমলাতন্ত্র হলো “আদর্শ প্রশাসনিক ব্যবস্থা”। ১৯৬০-এর দশকে ভারত ও পাকিস্তানে আমলাতন্ত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ২০২১ সালের বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। তবে আমলাতন্ত্রের জটিলতার কারণে ই-গভর্নেন্স চালু করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ৫০% সরকারি সেবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।