- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতিতে, একটি একচেটিয়া ফার্ম বাজারের একটি অনন্য সত্তা, যা পণ্যের সরবরাহ এবং মূল্য নির্ধারণে প্রায় নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ উপভোগ করে। অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ফার্মগুলোর মতো এরা শুধুমাত্র বর্তমান বাজারমূল্যকে অনুসরণ করে না, বরং নিজেরাই সেই মূল্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। এই কারণেই তাদের ‘দাম সৃষ্টিকারী’ (price maker) বলা হয়, যা তাদের বাজারের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
১। একক বিক্রেতা: একটি একচেটিয়া বাজারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এখানে একটিমাত্র ফার্ম থাকে, যা সম্পূর্ণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এই একক বিক্রেতা পণ্যের সরবরাহ এবং মূল্য নির্ধারণের একক কর্তৃত্ব লাভ করে। যেহেতু এর কোনো প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাই ভোক্তাদের অন্য কোনো বিকল্পের কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। এর ফলে, ফার্মটি নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে এবং চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা তাকে ‘দাম সৃষ্টিকারী’ হিসেবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়।
২। উচ্চ প্রবেশ বাধা: একচেটিয়া বাজারে নতুন ফার্মের প্রবেশ প্রায় অসম্ভব। এই প্রবেশ বাধা বিভিন্ন রূপ নিতে পারে, যেমন: সরকারি লাইসেন্স, পেটেন্ট, বিশাল পুঁজির প্রয়োজনীয়তা, অথবা প্রাকৃতিক সম্পদ বা প্রযুক্তির উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। এই বাধাগুলো নিশ্চিত করে যে অন্য কোনো ফার্ম বাজারে প্রবেশ করে বর্তমান ফার্মের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। ফলে, বিদ্যমান ফার্মটি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপ ছাড়াই পণ্যের মূল্য নিজের ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করতে পারে।
৩। মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা: প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ফার্মগুলো বাজার দ্বারা নির্ধারিত মূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য থাকে, কিন্তু একটি একচেটিয়া ফার্মের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে বা কমিয়ে নিজেদের মুনাফা সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করে। যদি তারা দাম বাড়াতে চায়, তারা জানে যে ক্রেতারা বিকল্পের অভাবে সেই দামেই পণ্যটি কিনতে বাধ্য হবে। একইভাবে, দাম কমালে তারা বাজারের সম্পূর্ণ ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে পারে। এই ধরনের সরাসরি মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকার কারণেই তাদের ‘দাম সৃষ্টিকারী’ বলা হয়।
৪। অস্থিতিস্থাপক চাহিদা: একচেটিয়া ফার্মের পণ্যের চাহিদা সাধারণত অস্থিতিস্থাপক হয়, অর্থাৎ দামের পরিবর্তনে চাহিদার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। যেহেতু এই ধরনের পণ্যের কোনো ঘনিষ্ঠ বিকল্প থাকে না, তাই দাম বাড়লেও ক্রেতারা অন্য কোনো পণ্য কিনতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ফার্মের বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকে, তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়লেও ক্রেতাদের তা কিনতেই হবে। এই চাহিদার অস্থিতিস্থাপকতার সুযোগ নিয়ে ফার্মটি উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করতে পারে।
৫। মুনাফা সর্বোচ্চকরণ: একটি একচেটিয়া ফার্মের মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা সর্বোচ্চ করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা এমন একটি উৎপাদন স্তর এবং মূল্য নির্ধারণ করে, যেখানে প্রান্তিক আয় (Marginal Revenue) প্রান্তিক ব্যয়ের (Marginal Cost) সমান হয়। এই বিন্দুতে পৌঁছানোর পর, তারা একটি উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে যা স্বাভাবিক প্রতিযোগিতামূলক বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি হয়। এই কৌশলটি তাদের ‘দাম সৃষ্টিকারী’ হিসেবে কাজ করতে সাহায্য করে, কারণ তারা নিজেদের লাভকে প্রাধান্য দিয়ে বাজারমূল্যকে প্রভাবিত করে।
৬। সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ: একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অসংখ্য বিক্রেতা থাকে, তাই কোনো একক বিক্রেতা চাইলেও সরবরাহের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যকে প্রভাবিত করতে পারে না। কিন্তু একচেটিয়া ফার্ম তার সম্পূর্ণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারা চাইলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে দাম বেড়ে যায়। আবার, দাম কমাতে চাইলে তারা সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে পারে। এই সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা কার্যকরভাবে বাজারের মূল্য কাঠামোকে নিজেদের অনুকূলে সাজিয়ে নিতে পারে।
৭। বিকল্পের অভাব: একচেটিয়া ফার্ম যে পণ্য বা সেবা বিক্রি করে, তার কোনো নিকটবর্তী বিকল্প সাধারণত বাজারে থাকে না। এই বৈশিষ্ট্যই তাদের দাম নির্ধারণের ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। যেহেতু ভোক্তাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প পণ্য কেনার সুযোগ নেই, তাই তাদের একমাত্র বিক্রেতার নির্ধারিত মূল্য মেনে নিতে হয়। যেমন, একটি নির্দিষ্ট ওষুধ যার পেটেন্ট শুধুমাত্র একটি কোম্পানির কাছে আছে, সেই কোম্পানি ইচ্ছামতো দাম ধার্য করতে পারে কারণ এই ওষুধের কোনো বিকল্প নেই।
৮। বাজারের অদক্ষতা: একটি একচেটিয়া ফার্মের কারণে বাজার সাধারণত অদক্ষ হয়। কারণ তারা এমন একটি উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে যা ভোক্তার অতিরিক্ত মূল্য (Consumer Surplus) হ্রাস করে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কল্যাণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদিও ফার্মটি বিপুল মুনাফা অর্জন করে, তবে সমাজের মোট কল্যাণ হ্রাস পায়, কারণ সীমিত সরবরাহ এবং উচ্চ মূল্যের কারণে অনেক সম্ভাব্য ক্রেতা পণ্যটি ক্রয় করতে পারে না। এই অদক্ষতার জন্য, সরকার প্রায়শই এই ধরনের বাজার নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করে।
উপসংহার: সুতরাং, একটি একচেটিয়া ফার্মকে ‘দাম সৃষ্টিকারী’ বলার কারণ হলো এর অনন্য বাজার কাঠামো। একক বিক্রেতা, প্রবেশে উচ্চ বাধা, পণ্যের বিকল্পের অভাব এবং মুনাফা সর্বোচ্চকরণের কৌশলগুলো তাদের বাজারমূল্যকে সরাসরি প্রভাবিত করার ক্ষমতা দেয়। এই ক্ষমতা তাদের সাধারণ ফার্ম থেকে আলাদা করে, যা শুধুমাত্র বাজার দ্বারা নির্ধারিত মূল্য মেনে চলে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই একচেটিয়া ফার্মকে অর্থনীতির অন্যতম শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
💡 একক বিক্রেতা 💡 উচ্চ প্রবেশ বাধা 💡 মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা 💡 অস্থিতিস্থাপক চাহিদা 💡 মুনাফা সর্বোচ্চকরণ 💡 সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ 💡 বিকল্পের অভাব 💡 বাজারের অদক্ষতা।
ঐতিহাসিকভাবে, কিছু একচেটিয়া ফার্ম এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে সরকার তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯১১ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানিকে (Standard Oil Company) ভেঙে দেয়, কারণ এটি তেল শিল্পে প্রায় সম্পূর্ণ একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক অ্যান্টিট্রাস্ট পদক্ষেপ। এছাড়া, ১৯৯০-এর দশকে মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছিল, যা তাদের বাজারের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে একচেটিয়া ফার্মগুলো তাদের ‘দাম সৃষ্টিকারী’ ক্ষমতাকে কীভাবে ব্যবহার করে এবং কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

