- readaim.com
- 0

কোমলমতি শিশুদের বিপথে যাওয়া কেবল তাদের জীবনকেই দুর্বিষহ করে তোলে না, বরং পরিবার ও সমাজের শান্তিও কেড়ে নেয়। এই সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। আসুন, আমরা কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় নিয়ে আলোচনা করি।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উপায়
১. পারিবারিক বন্ধন জোরদার করা:- একটি শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, নিয়মিত খোঁজখবর রাখা এবং তাদের সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা কিশোরদের বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। পারিবারিক কলহ ও অস্থিরতা শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা তাদের অপরাধমূলক কাজের দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই, একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল পারিবারিক পরিবেশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
২. সঠিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ:- বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা দান করাই যথেষ্ট নয়। শিশুদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের মানসিক বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। শিক্ষকেরাও বন্ধুসুলভ আচরণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঠিক পথে চালিত করতে পারেন।
৩. স্বাস্থ্যকর সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি:- শিশুরা তাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে শেখে। বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গীর প্রভাব তাদের জীবনে অত্যন্ত গভীর। খারাপ সঙ্গ এড়িয়ে চলা এবং সুস্থ, সৃজনশীল ও ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশের সাথে যুক্ত থাকার সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। এলাকায় খেলার মাঠ, পাঠাগার এবং যুব ক্লাব স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে কিশোররা গঠনমূলক activities-এ অংশগ্রহণ করতে পারবে।
৪. গণমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার:- টেলিভিশন, সিনেমা ও ইন্টারনেট শিশুদের মনোজগতে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। সহিংসতা ও অপরাধমূলক দৃশ্যসম্বলিত অনুষ্ঠান তাদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে। গণমাধ্যমে সুস্থ ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা এবং শিশুদের মধ্যে এর সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। অভিভাবকদেরও এ বিষয়ে নজর রাখা উচিত।
৫. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সচেতনতা ও সহযোগিতা:- কিশোর অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কিশোরদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় শিশুদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। একই সাথে, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে অপরাধ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
৬. মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান:- অনেক সময় পারিবারিক বা সামাজিক কারণে কিশোররা মানসিক চাপে ভোগে এবং হতাশা থেকে অপরাধের পথে পা বাড়ায়। স্কুল এবং কমিউনিটি পর্যায়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যেখানে প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানী কিশোরদের মানসিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারেন। দ্রুত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে অনেক কিশোরকে বিপথ থেকে ফেরানো সম্ভব।
৭. দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস:- দারিদ্র্য অনেক সময় কিশোর অপরাধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অভাবের তাড়নায় অনেক শিশু চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সরকারের উচিত দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করা। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষা ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
৮. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি:- লেখাপড়ার পাশাপাশি কিশোরদের বিভিন্ন কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া উচিত। এর মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে এবং অপরাধমূলক কাজ থেকে দূরে থাকবে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৯. পুনর্বাসন ও সংশোধনী কার্যক্রম জোরদার করা:- যারা ইতিমধ্যে কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের জন্য উপযুক্ত পুনর্বাসন ও সংশোধনী কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি। সংশোধন কেন্দ্রে তাদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। সমাজের উচিত তাদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা।
১০. সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক আন্দোলন:- কিশোর অপরাধের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং এর বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে। সমাজের সকল স্তরের মানুষ, যেমন শিক্ষক, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমকর্মী—সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
শেষকথা:- কিশোর অপরাধ একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যার সমাধানে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও সরকার—সকলকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই একটি সুস্থ ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
একনজরে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উপায়সমূহ:-
- পারিবারিক বন্ধন জোরদার
- সঠিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ
- স্বাস্থ্যকর সামাজিক পরিবেশ
- গণমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার
- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সচেতনতা
- মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ ও সহায়তা
- দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস
- কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ
- পুনর্বাসন ও সংশোধনী কার্যক্রম
- সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক আন্দোলন
বাংলাদেশে ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮% কিশোর অপরাধী মাদকাসক্তির শিকার। ইউনিসেফের মতে, দারিদ্র্য ও অশিক্ষা ৪০% কিশোর অপরাধের মূল কারণ। ২০২০ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রিপোর্ট করে যে, ১৫-১৮ বছর বয়সীদের অপরাধ ২৫% বেড়েছে। মনোবিদ ড. মেহেদী হাসান বলেন, “পরিবার ও স্কুলের সমন্বয়ে মনিটরিং বাড়ালে অপরাধ কমবে।” সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কিশোর সংশোধন কেন্দ্র বাড়ানো জরুরি।