- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতিতে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বুঝতে সাহায্যকারী মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি অন্যতম। সহজ কথায়, এই বিধিটি আমাদের জানায় যে উৎপাদনের একটি উপকরণ (যেমন: শ্রম) ক্রমাগত বাড়াতে থাকলে, এক পর্যায়ে মোট উৎপাদনে এর অবদান বা বৃদ্ধি কমতে শুরু করে। এই ধারণাটি কেবল তত্ত্বীয় আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি কৃষিক্ষেত্র থেকে শুরু করে আধুনিক শিল্প কারখানা—সর্বত্রই উৎপাদন পরিকল্পনা ও সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই বিধির কার্যকর জ্ঞান যেকোনো উদ্যোক্তা বা নীতিনির্ধারকের জন্য অপরিহার্য।
শাব্দিক অর্থ: ‘ক্রমহ্রাসমান’ (Diminishing) বলতে ধীরে ধীরে কমে যাওয়া বা হ্রাস পাওয়াকে বোঝায়। ‘প্রান্তিক’ (Marginal) বলতে উৎপাদনের অতিরিক্ত এক একক পরিবর্তনের ফলে মোট উৎপাদনে যে পরিবর্তন হয়, তাকে বোঝায়। আর ‘উৎপাদন বিধি’ (Law of Production) হলো উৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক নিয়ম। অর্থাৎ, ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি-এর আভিধানিক অর্থ হলো: “উৎপাদনের কোনো একটি উপকরণের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মোট উৎপাদনে যে অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটে, তার ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার নিয়ম।”
ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি (Law of Diminishing Marginal Returns), যা ক্ষেত্রবিশেষে ক্রমহ্রাসমান প্রতিদান বিধি নামেও পরিচিত, অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বল্পমেয়াদী উৎপাদন বিধি। এই বিধি অনুসারে, অন্যান্য উপকরণের (যেমন: জমি, যন্ত্রপাতি, মূলধন ইত্যাদি) পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখে যদি শুধুমাত্র একটি পরিবর্তনশীল উপকরণের (যেমন: শ্রম) ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ানো হয়, তবে একটি নির্দিষ্ট সীমার পরে, পরিবর্তনশীল উপকরণটির প্রতিটি অতিরিক্ত একক ব্যবহারের ফলে মোট উৎপাদনে যে অতিরিক্ত যোগ হয় (অর্থাৎ, প্রান্তিক উৎপাদন), তা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। উৎপাদনের উপকরণগুলোর সঠিক সমন্বয় না ঘটলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।
এই বিধিটি বহু প্রাচীন হলেও আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ এটিকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিচে কয়েকজন প্রখ্যাত গবেষক/অর্থনীতিবিদের সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:
১।অধ্যপক মার্শাল বলেছেন, “একটি নির্দষ্ট জমিতে শ্রম এবং মূলধন যত অধিক পরিমাণে লাগানো হয়, প্রান্তিক উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায়।”
২।আলফ্রেড মার্শাল (Alfred Marshall): “যদি কৃষিকাজে শ্রম ও মূলধনের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়, তবে সাধারণভাবে কিছুকাল পরে অতিরিক্ত প্রতিদানগুলো একটি ক্রমহ্রাসমান হারে আসবে, অর্থাৎ, উৎপাদনের অতিরিক্ত বৃদ্ধির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে।”
৩।ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo): “যেহেতু উৎকৃষ্ট জমি ব্যবহারের পরে তুলনামূলকভাবে কম উর্বর জমি বা একই জমিতে বেশি বিনিয়োগ করতে হয়, তাই এই জমিতে পরবর্তী বিনিয়োগগুলি থেকে প্রাপ্ত প্রতিদান কম হতে থাকে।”
৪।পল স্যামুয়েলসন (Paul Samuelson): “যদি আমরা একটি উপকরণকে স্থির রেখে অন্য একটি পরিবর্তনশীল উপকরণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে যাই, তবে অন্যান্য উপকরণ স্থির থাকায় পরিবর্তনশীল উপকরণটির প্রান্তিক প্রতিদান একসময় হ্রাস পেতে শুরু করে।”
৫।স্টিগলার বলেছেন, “উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাবহৃত অন্যান্য উপাদানকে স্থির রেখে একটি উপাদানকে সমহারে বাড়াতে থাকলে একটি নির্দিষ্ট অবস্থার পরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত উৎপাদন ক্রমেই হ্রাস পায়।”
৬।এফ. বেনহাম (Frederic Benham): “অন্যান্য উপকরণের যোগান স্থির রেখে যদি কোনো একটি উপকরণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়, তবে মোট উৎপাদনে পরিবর্তনশীল উপকরণটির প্রান্তিক অবদান একসময় হ্রাস পেতে বাধ্য।”
৭।জন মেনার্ড কেইন্স (John Maynard Keynes): কেইন্স সরাসরি এই বিধির সংজ্ঞা না দিলেও, তার সমসাময়িক এবং পরবর্তী অর্থনীতিবিদরা তাঁর সাধারণ তত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে স্বল্পমেয়াদী উৎপাদন ফাংশনের প্রসঙ্গে এই বিধিটিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
৮।জোয়ান রবিনসন (Joan Robinson): “একটি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যখন স্থির উপকরণের সাথে পরিবর্তনশীল উপকরণকে একত্রিত করা হয়, তখন পরিবর্তনশীল উপকরণের প্রতিটি অতিরিক্ত একক দ্বারা প্রাপ্ত উৎপাদন একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর পরে কমতে থাকে।”
৮।জর্জ স্টিগলার (George Stigler): “যদি উৎপাদনের একটি উপকরণকে স্থির রাখা হয় এবং অন্য একটি উপকরণকে ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়, তবে পরিবর্তনশীল উপকরণটির প্রান্তিক উৎপাদন অবশেষে হ্রাস পেতে থাকবে।”
ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধিটির বিশ্লেষণ:-
বিভিন্ন উপাদনকে স্থির রেখে কোন একটি মাত্র উপাদানকে বাড়াতে থাকলে মোন উৎপাদন (TP) প্রথম দিকে ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা (MP) বাড়তে থাকে। একটি পর্যায়ে মোট উৎপাদন (TP) এর ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি থেমে যায় এবং ক্রমহ্রাসমান হারে বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায়, প্রান্তিক উৎপাদন সর্বচ্চ পর্যায়ে পৌছায়। এর পরও উপাদান নিয়োগ বাড়াতে থাকলে প্রান্তিক উৎপাদন (MP) ক্রমাগত কমতে থাকে। মোট উৎপাদন (TP) সর্বচ্চ পর্যায়ে পৌছালে প্রন্তিক উৎপাদন (MP) শূন্য হয়। পরিবর্তন উপাদানটিকে আরও বাড়াতে থাকলে মোট উৎপাদন কমতে থাকে এবং প্রন্তিক উৎপাদন ঋণাত্নক হয়। উৎপাদনের এবিধিকে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি বলা হয়।
ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধির পর্যায়:- ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপাদান বিধির মোট তিনটি পর্যায় লক্ষ করা যায়। পর্যায়গুলি হল –
- ক) ক্রমবর্ধমান উৎপাদন পর্যায়।
- খ) ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন পর্যায়।
- গ) ঋণাত্নক উৎপাদন পর্যায়।
ক) ক্রমবর্ধমান উৎপাদন পর্যায়: এই পদ্ধতিতে পরিবর্তনীয় উপাদান বাড়ানোর ফলে মোট উৎপাদন ক্রমবর্ধমানহারে বাড়ে, ফলে প্রান্তিক উৎপাদন বাড়ে। এ পর্যায়ে গড় উৎপাদনও বাড়ে। পরবর্তীতে মোট উৎপাদন বাড়ে ঠিকই কিন্তু এর বৃদ্ধির হার কমে যায়। তখন প্রান্তিক উৎপাদন কমে ১৬০ একক হতে ১২০ একক হয়। গড় উৎপাদন এক্ষেত্রে সর্বচ্চ হয় এবং স্থির থাকে। ফলে গড় উৎপাদন সর্বচ্চ অবস্থায়, গড় উৎপাদন = প্রান্তিক উৎপাদন হয়। সড় ঋৎপাদন ও প্রান্তিক ঋৎপাদন সমান হওয়া পর্যন্ত উৎপাদনের পর্যায়কে প্রথম পর্যায় বলে। প্রথম পর্যায়ের গড় উৎপাদন সর্বচ্চ পর্যায়ে বাড়ে। প্রান্তিক উৎপাদনও বেশ কিছুকাল ক্রমবর্ধমান, তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছানোর পর তার কমে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।
খ) ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন পর্যায়: এই প্রকারে মোট উৎপাদন ক্রমহ্রাসমান হারে বাড়ে। অর্থাৎ, প্রান্তিক উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে। গড় উৎপাদনও কমতে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষ এককে মোট উৎপাদন সর্বচ্চহয় এবং প্রান্তিক উৎপাদন শূন্য হয়। সুতরাং প্রান্তিক উৎপাদন শূন্যাবস্থা পর্যন্ত ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন পর্যায় হিসেবে গণ্য হয়।
গ) ঋণাত্নক উৎপাদন পর্যায়: এপর্যায়ে মোট উৎপাদিন কমতে থাকে এবং প্রান্তিক উৎপাদন ঋণাত্নক হয়। গড় উৎপাদন কখনও ঋণাত্নক হয় না। গড় উৎপাদন কখনও ঋণাত্নক হয় না, তবে তা এ পর্যায়ে সর্বনিম্ন হয়। প্রান্তিক উৎপাদন শূন্য হতে ঋনাত্নক অবস্থাকে উৎপাদনের ঋনাত্নক বলে গণ্য করা হয়।
চিত্রের সাহায্যে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি:-


চিত্রের মাধমে ভূমি অক্ষে পরিবর্তনীয় উৎপাদনকে বাড়াতে থাকলে মোট উৎপাদন TP ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ে। I বিন্দু পর্যন্ত মোট উৎপাদন ক্রমবর্ধমান। I বিন্দুর পর মোট উৎপাদন ক্রমবর্ধমান হারে না বেড়ে ক্রমহ্রাসমান হারে বাড়ে।
I বিন্দুকে বলা হয় Point of Inflexion. কারণ TP রেখা I বিন্দুতে তার মোড় পরিবর্তন করে। I বিন্দুর সাথে সম্পর্কিত I1 বিন্দুতে প্রান্তিক উৎপাদন MP সর্বাধিক হয়। আবার M বিন্দুতে গড় উৎপাদন AP সর্বোচ্চ হয়। তখন গড় উৎপাদন ও প্রান্তিক উৎপাদন সমান হয়। অর্থৎ, MP = AP হয়। এটা ক্রমবর্ধমান প্রান্তিক উৎপাদন নির্দেশ করে।
MP = AP এর পরবর্তীতে পরিবর্তনীয় উপাদানকে বাড়াতে থাকলে মোট উৎপাদন TP বাড়বে। কিন্তু এ বাড়ার হার হবে ক্রমহ্রাসমান। যে কারণে প্রান্তিক উৎপাদন MP কমতে শুরু করে। চিত্রঅনুযায়ী M বিন্দুতে TP সর্বাধিক এবং MP সর্বনিম্ন হয়। আর এই অবস্থাটিই ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা নির্দেশ করে। এর পরেও পরিবর্তনীয় উপাদানকে বাড়ানো হলে মোট উৎপাদন কমতে থাকে। আর প্রান্তিক উৎপাদন ঋণাত্নক হয়।
উপসংহার: ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি অর্থনীতিতে একটি মৌলিক এবং চিরায়ত ধারণা। এটি আমাদের শেখায় যে উৎপাদনের উপকরণগুলোর মধ্যে একটি আদর্শ অনুপাত বজায় রাখা কতটা জরুরি। এই বিধির কার্যকর জ্ঞান উদ্যোক্তাদের অযথা অপচয় এড়িয়ে সম্পদের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এই নীতির প্রয়োগের মাধ্যমেই একটি ফার্ম তার সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য উৎপাদনের সবচেয়ে কার্যকর মাত্রা নির্ধারণ করতে পারে। তাই, সম্পদ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ পর্যন্ত, এই বিধিটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

