- readaim.com
- 0

উত্তর::উপস্থাপনা:- মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করার কারণে আমাদের জীবনে ঘটে নানা ঘটনা, তৈরি হয় বিভিন্ন পরিস্থিতি। এই সামাজিক ঘটনা ও পরিস্থিতিগুলো বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে এবং এর পেছনের কারণগুলো জানতে প্রয়োজন হয় সুশৃঙ্খল ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির। আর এই নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিই হলো সামাজিক গবেষণার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। অনুসন্ধিৎসু মন যখন সমাজের গভীরে ডুব দেয়, তখন এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই পথ দেখায়, কুসংস্কার আর ভুল ধারণার বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেয়। আসুন, সহজ ভাষায় জেনে নিই সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো।
সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ধাপসমূহ:-
১।একটি গবেষণার বিষয়:- সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান কোনো সমস্যা, আগ্রহদ্দীপক ঘটনা, অথবা জ্ঞানের অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে এই বিষয়টি নির্বাচন করা হয়ে থাকে। বিষয় নির্বাচন এমন হতে হবে যা সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং যার গবেষণা করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের কারণ ও প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হতে পারে।
২।সমস্যাটিকে সংজ্ঞায়িত করা:- নির্বাচিত বিষয়টি আসলে কী এবং এর পরিধি কতটুকু, তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা জরুরি। বাল্যবিবাহের গবেষণায়, এর আইনি সংজ্ঞা, প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি এবং ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
৩।সাহিত্য পর্যালোচনা করা:- নির্বাচিত বিষয়ের উপর পূর্বে কী কী গবেষণা হয়েছে, সেই সংক্রান্ত জার্নাল, বই, প্রবন্ধ ইত্যাদি অধ্যয়ন করা হয়। এই পর্যালোচনা বর্তমান গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করে এবং নতুন জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচন করতে সাহায্য করে। বাল্যবিবাহ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমে গবেষক পূর্বেকার findings এবং gap গুলো সম্পর্কে জানতে পারেন।
৪।গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা:- এই গবেষণা কী জানতে চায় বা কী অর্জন করতে ইচ্ছুক, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। বাল্যবিবাহের গবেষণার উদ্দেশ্য হতে পারে এর মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মূল্যায়ন করা।
৫।অনুমান গঠন করা:- গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সম্ভাব্য উত্তর বা ব্যাখ্যা তৈরি করা হয়, যা পরবর্তীতে তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে যাচাই করা হবে। যেমন, একটি অনুমান হতে পারে – দারিদ্র্য বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ।
৬।গবেষণার নকশা প্রণয়ন করা:- কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হবে, কতজন অংশগ্রহণকারী থাকবে, এবং কোন পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে (যেমন – জরিপ, সাক্ষাৎকার, পর্যবেক্ষণ) তার একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। বাল্যবিবাহের কারণ অনুসন্ধানে জরিপ পদ্ধতি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।
৭।নমুনা নির্বাচন করা:- গবেষণার জন্য সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ নির্বাচন করা হয়, যাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এই নমুনা যেন সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে সেদিকে ध्यान রাখা জরুরি।
৮।তথ্য সংগ্রহ করা:- পূর্বে প্রণীত নকশা অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপ, সাক্ষাৎকার, দলগত আলোচনা, এবং নথি পর্যালোচনা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি।
৯।সংগৃহীত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বিশ্লেষণ করা:- সংগৃহীত কাঁচা তথ্যগুলোকে বোধগম্য রূপে আনার জন্য শ্রেণীবদ্ধ করা, সারণী তৈরি করা এবং বিভিন্ন statistical পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমেই অনুমিত সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়।
১০।ফলাফল উপস্থাপন করা:- বিশ্লেষণের পর প্রাপ্ত ফলাফল সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার চিত্র, লেখচিত্র ও সারণী ব্যবহার করা যেতে পারে।
১১।সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা:- প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে পূর্বে গঠিত অনুমানের সত্যতা যাচাই করা হয় এবং গবেষণার মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে কিনা তা দেখা হয়।
১২।সাধারণীকরণ করা:- যদি নমুনা সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, তবে প্রাপ্ত ফলাফল বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
প্রতিটি গবেষণার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। এই সীমাবদ্ধতাগুলো সততার সাথে উল্লেখ করা ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
১৪।নীতি নির্ধারণে সুপারিশ:- গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু বাস্তবসম্মত সুপারিশ পেশ করা যেতে পারে। বাল্যবিবাহের কারণ ও প্রভাব বিশ্লেষণের পর এর প্রতিরোধে কিছু নীতিগত সুপারিশ করা যেতে পারে।
১৫।গোপনীয়তা রক্ষা করা:- গবেষণার নৈতিক দিক বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অংশগ্রহণকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করা, তাদের সম্মতি নেওয়া এবং গবেষণার কারণে তাদের কোনো ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
১৬।সময় ও বাজেট নির্ধারণ করা:- সময় ও বাজেট এর সঠিক ব্যবস্থাপনা গবেষণার সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ধাপের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ এবং বাজেট অনুযায়ী কাজ করা প্রয়োজন।
১৭।বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করা:- যোগাযোগ ও প্রতিবেদন তৈরি গবেষণা প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গবেষণার অগ্রগতি এবং ফলাফল নিয়মিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সম্প্রদায়ের সাথে শেয়ার করা উচিত। একটি সুস্পষ্ট এবং বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করাও জরুরি।
১৮।ভুল ত্রুটি চিহ্নিত করা:- পুনর্বিবেচনা ও মূল্যায়ন সমগ্র গবেষণা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর এর প্রতিটি ধাপ পুনর্বিবেচনা করা উচিত। কোনো ভুল ত্রুটি থাকলে তা চিহ্নিত করা এবং ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য শিক্ষা নেওয়া উচিত।
১৯।তথ্য সংরক্ষণ ও ভাগাভাগি কারা:- গবেষণার তথ্য-উপাত্ত ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য সংরক্ষণ করা উচিত। সুযোগ থাকলে অন্যান্য গবেষকদের সাথে এই তথ্য ভাগ করে নেওয়া জ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়ক হতে পারে।
২০।প্রযুক্তির ব্যবহার কার:- সামাজিক গবেষণায় বর্তমানে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ডেটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার গবেষণাকে আরও নির্ভুল ও দ্রুততর করে তোলে।
উপসংহার:- সামাজিক গবেষণার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি একটি সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়া, যা সমাজ এবং মানুষের আচরণ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে সহায়ক। বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে ফলাফল উপস্থাপন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একটির সাথে অন্যটি গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা সমাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে পারি এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে একটি উন্নত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারি।
গবেষণার বিষয় নির্বাচন, সমস্যা সংজ্ঞায়িতকরণ, সাহিত্য পর্যালোচনা, গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণ, অনুমান গঠন, গবেষণার নকশা প্রণয়ন, নমুনা নির্বাচন, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বিশ্লেষণ, ফলাফল উপস্থাপন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সাধারণীকরণ, গবেষণার সীমাবদ্ধতা উল্লেখ, নীতি নির্ধারণে সুপারিশ, গবেষণার নৈতিক দিক বিবেচনা, সময় ও বাজেট ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ও প্রতিবেদন তৈরি, পুনর্বিবেচনা ও মূল্যায়ন, তথ্য সংরক্ষণ ও ভাগাভাগি, প্রযুক্তির ব্যবহার, আন্তঃবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁৎ (Auguste Comte) সামাজিক ঘটনা অধ্যয়নের জন্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। এর ফলস্বরূপ, সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন জরিপ সংস্থা যেমন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে, যা নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, BBS এর মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (MICS) শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুরক্ষা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের শুরুতে এমিল ডুরখেইম (Émile Durkheim) এর মতো সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক গবেষণায় পরিসংখ্যানগত পদ্ধতির ব্যবহারকে আরও সুদৃঢ় করেন। তাদের কাজ সামাজিক ঘটনাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে অধ্যয়নের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বর্তমানে, ইন্টারনেট এবং মোবাইল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার সামাজিক গবেষণার তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিকে আরও সহজ ও বিস্তৃত করেছে।