- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতির মৌলিক দুটি ধারণা হলো চাহিদা এবং সরবরাহ। এদের মধ্যে চাহিদার ধারণাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাজার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসাবে চাহিদা বিভিন্ন কারণে ওঠানামা করে। চাহিদার এই পরিবর্তনকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: চাহিদার সংকোচন-সম্প্রসারণ এবং চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি। আপাতদৃষ্টিতে এই দুটি ধারণা একই মনে হলেও, এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা এই দুটি ধারণার মধ্যকার সূক্ষ্ম কিন্তু মৌলিক পার্থক্যগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
১। দামের প্রভাব: চাহিদার সংকোচন এবং সম্প্রসারণ ঘটে শুধুমাত্র পণ্যের নিজস্ব দামের পরিবর্তনের কারণে। অন্যান্য সকল বিষয় (যেমন – ক্রেতার আয়, সম্পর্কিত পণ্যের দাম, রুচি ইত্যাদি) অপরিবর্তিত থাকলে, পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে চাহিদার পরিমাণ কমে যায়, যাকে চাহিদার সংকোচন বলা হয়। অন্যদিকে, পণ্যের দাম হ্রাস পেলে চাহিদার পরিমাণ বেড়ে যায়, যাকে চাহিদার সম্প্রসারণ বলা হয়। এটি চাহিদাবিধির সরাসরি প্রয়োগ। এই পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট চাহিদারেখার উপরই সংঘটিত হয়।
২। একই রেখায় পরিবর্তন: চাহিদার সংকোচন এবং সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে চাহিদার রেখাটি অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ, ক্রেতার আচরণ বা পছন্দের কোনো পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তনটি কেবল একটি নির্দিষ্ট চাহিদা রেখার বিভিন্ন বিন্দুতে ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি চকলেটের দাম ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫ টাকা হয়, তবে চাহিদার পরিমাণ কমে যাবে, এবং এই পরিবর্তনটি চাহিদারেখার উপরের দিকে একটি নতুন বিন্দুতে স্থানান্তরিত হবে। এটিই চাহিদার সংকোচন।
৩। পরিমাণগত পরিবর্তন: এটি চাহিদার পরিমাণের একটি পরিবর্তন। অর্থাৎ, ক্রেতার কেনা পণ্যের সংখ্যা বা পরিমাণ হ্রাস পায় অথবা বৃদ্ধি পায়। এটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণগত পরিবর্তন, যা বাজারের ভারসাম্যকে সরাসরি প্রভাবিত করে। দামের পরিবর্তনের ফলে চাহিদার পরিমাণের এই পরিবর্তনটি চাহিদারেখা বরাবর ওপর বা নিচে চলাচল দ্বারা নির্দেশিত হয়।
৪। স্থির চাহিদা রেখা: চাহিদার সংকোচন এবং সম্প্রসারণ প্রক্রিয়াটি একটি স্থির চাহিদা রেখার ধারণার ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, আমরা ধরে নিই যে ক্রেতার রুচি, পছন্দ, আয় এবং অন্যান্য পণ্যের দামের মতো চাহিদাকে প্রভাবিত করে এমন অন্যান্য সমস্ত কারণ অপরিবর্তিত থাকে। এই স্থিতিশীলতা চাহিদার এই নির্দিষ্ট পরিবর্তনকে বোঝা সহজ করে তোলে।
৫। দাম ছাড়া অন্যান্য কারণ: চাহিদার হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে দাম ছাড়া অন্য যেকোনো কারণে। অর্থাৎ, পণ্যের দাম অপরিবর্তিত থাকা সত্ত্বেও যদি ক্রেতার আয় বৃদ্ধি পায়, রুচি পরিবর্তিত হয়, বা সম্পর্কিত পণ্যের দাম পরিবর্তিত হয়, তাহলে চাহিদার পরিবর্তন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ক্রেতার আয় বৃদ্ধি পায়, তাহলে একই দামে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, যাকে চাহিদার বৃদ্ধি বলা হয়।
৬। রেখার স্থানান্তর: চাহিদার হ্রাস এবং বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চাহিদারেখাটি সম্পূর্ণভাবে স্থানান্তরিত হয়। চাহিদার বৃদ্ধি হলে রেখাটি ডানদিকে সরে যায় এবং চাহিদার হ্রাস হলে রেখাটি বামদিকে সরে যায়। এর কারণ হলো, দাম একই থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো কারণে সামগ্রিক চাহিদা পরিবর্তিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কফির দাম অপরিবর্তিত থাকা সত্ত্বেও চায়ের দাম বেড়ে যায়, তাহলে কফির চাহিদা বেড়ে যাবে এবং কফির চাহিদা রেখাটি ডানদিকে স্থানান্তরিত হবে।
৭। গুণগত পরিবর্তন: এটি চাহিদার একটি গুণগত পরিবর্তন। অর্থাৎ, পুরো বাজার বা ক্রেতার আচরণে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসে, যা শুধু পরিমাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ব্যাপক পরিবর্তন, যা নতুন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে। চাহিদার বৃদ্ধি বা হ্রাস একটি নতুন চাহিদা রেখা তৈরি করে, যা বাজারের নতুন চাহিদা পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করে।
৮। চাহিদাবিধির ব্যতিক্রম: চাহিদার হ্রাস বা বৃদ্ধি প্রায়শই চাহিদাবিধির বাইরে ঘটে, কারণ দামের পরিবর্তন এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে না। এই পরিবর্তনগুলো বাজারের পরিবেশ, সামাজিক প্রবণতা, সরকারি নীতি, বা অন্যান্য বাহ্যিক কারণ দ্বারা চালিত হয়, যা সাধারণত চাহিদা বিধির পরিধির বাইরে থাকে।
উপসংহার: চাহিদার সংকোচন-সম্প্রসারণ এবং চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি উভয়ই চাহিদার পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, কিন্তু এদের কারণ এবং প্রকৃতি ভিন্ন। সহজ কথায়, চাহিদার সংকোচন-সম্প্রসারণ ঘটে শুধুমাত্র দামের পরিবর্তনের কারণে এবং এটি একটি একই রেখার উপর চলাচল দ্বারা নির্দেশিত হয়। অন্যদিকে, চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে দাম ব্যতীত অন্য যেকোনো কারণে এবং এটি সম্পূর্ণ রেখার স্থানান্তর দ্বারা নির্দেশিত হয়। অর্থনীতির এই মৌলিক পার্থক্যটি বাজারের আচরণ, মূল্য নির্ধারণ এবং সরকারি নীতি প্রণয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভূমিকা:-অর্থনীতিতে চাহিদা সংক্রান্ত আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদার পরিবর্তনকে প্রধানত দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়, যা প্রায়শই শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে। এগুলি হলো চাহিদার সংকোচন-সম্প্রসারণ এবং চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি। যদিও শব্দগুলো শুনতে একই রকম মনে হয়, তবে এদের মধ্যে সুস্পষ্ট ও মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। এই পার্থক্যগুলো জানা বাজার ব্যবস্থা সঠিকভাবে বোঝার জন্য অপরিহার্য।
১। সংজ্ঞা: নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে শুধু দ্রব্যের নিজের দাম কমার ফলে চাহিদার পরিমাণ বাড়লে তাকে চাহিদার সম্প্রসারণ বলে। বিপরীতভাবে, দাম বাড়ার ফলে চাহিদার পরিমাণ কমলে তাকে চাহিদার সংকোচন বলা হয়। অন্যদিকে, দ্রব্যের নিজের দাম স্থির থেকে অন্যান্য নির্ধারক, যেমন – ভোক্তার আয়, রুচি বা অভ্যাস পরিবর্তনের ফলে চাহিদা বাড়লে তাকে চাহিদার বৃদ্ধি এবং চাহিদা কমলে তাকে চাহিদার হ্রাস বলে।
২। মূল কারণ: চাহিদার সংকোচন ও সম্প্রসারণ ঘটার একমাত্র কারণ হলো দ্রব্যের নিজস্ব দামের পরিবর্তন। এখানে দামই প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে এবং অন্যান্য বিষয় স্থির থাকে। পক্ষান্তরে, চাহিদার হ্রাস ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দ্রব্যের নিজস্ব দাম স্থির থাকে। এটি মূলত ভোক্তার আয়, রুচি, আবহাওয়া, সম্পর্কিত অন্য দ্রব্যের দাম ইত্যাদি পরিবর্তনের কারণে ঘটে থাকে।
৩। চাহিদা রেখার অবস্থান: চাহিদার সংকোচন ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট চাহিদা রেখার বিভিন্ন বিন্দুর মধ্যে চলাচল বোঝায়। অর্থাৎ, দামের পরিবর্তনের ফলে চাহিদা রেখা বরাবর চাহিদা ওপরের বিন্দু থেকে নিচের বিন্দুতে (সম্প্রসারণ) বা নিচের বিন্দু থেকে ওপরের বিন্দুতে (সংকোচন) স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু চাহিদা রেখাটি নিজে কোনো স্থান পরিবর্তন করে না।
৪। রেখার স্থানান্তর: চাহিদার হ্রাস ও বৃদ্ধির ফলে সম্পূর্ণ চাহিদা রেখাটিই স্থান পরিবর্তন করে। চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে চাহিদা রেখাটি ডানদিকে স্থানান্তরিত হয়, যা একটি নতুন চাহিদা রেখা তৈরি করে। একইভাবে, চাহিদার পরিমাণ হ্রাস পেলে চাহিদা রেখাটি বামদিকে সরে গিয়ে একটি নতুন চাহিদা রেখা গঠন করে। এখানে মূল রেখার কোনো অস্তিত্ব থাকে না।
৫। প্রভাব: চাহিদার সংকোচন ও সম্প্রসারণ মূলত দামের পরিবর্তনের প্রতি ভোক্তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। এটি বাজারে দ্রব্যের দামের ওঠানামার সাথে চাহিদার পরিমাণের সম্পর্ক দেখায়। অন্যদিকে, চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি ভোক্তার জীবনযাত্রার মান, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সামাজিক পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবকে প্রতিফলিত করে, যা বাজারের কাঠামোগত পরিবর্তন নির্দেশ করে।
৬। ধারণাগত ভিন্নতা: চাহিদার সংকোচন-সম্প্রসারণ একটি পরিমাণগত পরিবর্তন (Quantitative Change) প্রকাশ করে, কারণ এটি একই চাহিদা সূচির মধ্যে रहकर শুধু চাহিদার পরিমাণের পরিবর্তন দেখায়। অপরদিকে, চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি একটি গুণগত বা কাঠামোগত পরিবর্তন (Qualitative or Structural Change) নির্দেশ করে, কারণ এর ফলে পূর্বের চাহিদা সূচি পরিবর্তিত হয়ে একটি নতুন চাহিদা সূচি তৈরি হয়।
৭। স্থির অবস্থা: চাহিদার সংকোচন ও সম্প্রসারণের ধারণাটি ‘অন্যান্য সকল অবস্থা অপরিবর্তিত’ (Ceteris Paribus) এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এখানে শুধুমাত্র দাম পরিবর্তনশীল। কিন্তু চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ‘অন্যান্য সকল অবস্থা অপরিবর্তিত’ অনুমানটি কার্যকর থাকে না, বরং সেই পরিবর্তনশীল বিষয়গুলোই এই পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
উপসংহার: সুতরাং, উপরের আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার যে, চাহিদার সংকোচন-সম্প্রসারণ এবং হ্রাস-বৃদ্ধি দুটি ভিন্ন অর্থনৈতিক ধারণা। প্রথমটি একই চাহিদা রেখায় দামের পরিবর্তনের কারণে চলাচলকে বোঝায়, আর দ্বিতীয়টি দাম ছাড়া অন্য কারণে সম্পূর্ণ চাহিদা রেখার স্থানান্তরকে নির্দেশ করে। এই দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য জানা না থাকলে অর্থনীতির চাহিদা তত্ত্ব বোঝা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং বাজার বিশ্লেষণে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
পয়েন্টগুলির তালিকা:
- ✓ সংজ্ঞা
- ✓ মূল কারণ
- ✓ চাহিদা রেখার অবস্থান
- ✓ রেখার স্থানান্তর
- ✓ প্রভাব
- ✓ ধারণাগত ভিন্নতা
- ✓ স্থির অবস্থা
১। দামের প্রভাব ২। একই রেখায় পরিবর্তন ৩। পরিমাণগত পরিবর্তন ৪। স্থির চাহিদা রেখা ৫। দাম ছাড়া অন্যান্য কারণ ৬। রেখার স্থানান্তর ৭। গুণগত পরিবর্তন ৮। চাহিদাবিধির ব্যতিক্রম।
অর্থনৈতিক ইতিহাসে চাহিদা ও দামের সম্পর্ক নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। ১৯ শতকের শেষের দিকে আলফ্রেড মার্শাল তার ‘Principles of Economics’ গ্রন্থে চাহিদা রেখার ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, বিভিন্ন বৈশ্বিক সংকট যেমন ১৯৩০ সালের মহামন্দা এবং ১৯৭০-এর দশকের তেল সংকট প্রমাণ করে যে, কেবল দাম নয়, বরং মানুষের আয়, প্রত্যাশা এবং অন্যান্য বাহ্যিক কারণও চাহিদাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৯০-এর দশকে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে প্রযুক্তি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি একটি আধুনিক উদাহরণ।

