- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: জাতীয় আয় হলো একটি দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থা পরিমাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে, একটি দেশের মোট উৎপাদিত পণ্য ও সেবার আর্থিক মূল্যকে বোঝায়। জাতীয় আয় পরিমাপের সঠিক পদ্ধতিগুলো অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারণ এর ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন এবং উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয়।
১।উৎপাদন পদ্ধতি: এই পদ্ধতি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেশের সকল ধরনের উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার মোট আর্থিক মূল্য গণনা করা হয়। এক্ষেত্রে, কৃষিক্ষেত্রে শস্য উৎপাদন, শিল্পক্ষেত্রে পোশাক ও যন্ত্রপাতি উৎপাদন, এবং সেবা খাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রতিটি সেক্টরের মোট উৎপাদনকে যোগ করা হয়। তবে, একই পণ্য একাধিকবার গণনা হওয়া (দ্বৈত গণনা) ঠেকাতে শুধুমাত্র চূড়ান্ত পণ্য ও সেবার মূল্য বিবেচনা করা হয়, যা অর্থনীতির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।
২।আয় পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে, জাতীয় আয় পরিমাপ করা হয় দেশের সকল নাগরিকের মোট আয়ের সমষ্টির ওপর ভিত্তি করে। এতে শ্রমিকদের মজুরি ও বেতন, উদ্যোক্তাদের মুনাফা, জমির মালিকদের খাজনা এবং মূলধনের ওপর প্রাপ্ত সুদ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই পদ্ধতিটি অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন পক্ষের আয়ের প্রবাহকে প্রতিফলিত করে, যা দেশের আয়ের ভারসাম্য সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দেয়।
৩।ব্যয় পদ্ধতি: এই পদ্ধতিটি দেশের মোট ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় আয় পরিমাপ করে। এতে ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়, সরকারি ব্যয়, বিনিয়োগ ব্যয় এবং নিট রপ্তানির (রপ্তানি থেকে আমদানি বাদ) সমষ্টিকে গণনা করা হয়। এই পদ্ধতিটি অর্থনীতির চাহিদার দিকটি তুলে ধরে এবং কীভাবে বিভিন্ন খাত তাদের অর্থ ব্যয় করছে, সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। এটি অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে বিশেষভাবে কার্যকর, কারণ এটি বাজারের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করে।
৪।নিট জাতীয় আয়: নিট জাতীয় আয় পরিমাপ করতে মোট জাতীয় আয় থেকে অবচয় বাদ দেওয়া হয়। অবচয় হলো মূলধন দ্রব্যের ব্যবহারজনিত ক্ষয় বা মূল্যহ্রাস। এটি ফ্যাক্টরি, মেশিনারি, বা অন্যান্য যন্ত্রপাতির নিয়মিত ব্যবহার থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতিকে বোঝায়। এই অবচয় বাদ দেওয়ার মাধ্যমে একটি দেশের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি অধিকতর সঠিক চিত্র পাওয়া যায়, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫।বাজার মূল্যে জাতীয় আয়: এই পদ্ধতি অনুযায়ী, জাতীয় আয় পরিমাপ করা হয় বাজার মূল্যে, অর্থাৎ যে দামে পণ্য ও সেবা বিক্রি হয়। এতে পরোক্ষ কর (যেমন ভ্যাট) অন্তর্ভুক্ত থাকে এবং ভর্তুকি বাদ দেওয়া হয়। বাজার মূল্যের হিসাব থেকে বোঝা যায় যে, ভোক্তারা একটি পণ্য বা সেবার জন্য প্রকৃত কত টাকা ব্যয় করছে। এটি সাধারণত জিডিপির (Gross Domestic Product) মতো পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৬।উৎপাদন ব্যয়ে জাতীয় আয়: এই পদ্ধতি অনুযায়ী, জাতীয় আয় পরিমাপ করা হয় উৎপাদন ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে, যা বাজার মূল্যে জাতীয় আয়ের ঠিক বিপরীত। এখানে বাজার মূল্যে জাতীয় আয় থেকে পরোক্ষ কর বাদ দেওয়া হয় এবং ভর্তুকি যোগ করা হয়। এটি একটি দেশের উৎপাদনকারীদের প্রকৃত আয়ের চিত্র তুলে ধরে। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, সরকার কীভাবে কর ও ভর্তুকির মাধ্যমে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে প্রভাব ফেলছে।
৭।মাথাপিছু জাতীয় আয়: এটি একটি দেশের মোট জাতীয় আয়কে সেই দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে নির্ণয় করা হয়। মাথাপিছু আয় থেকে একটি দেশের নাগরিকদের গড় জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়। এটি বিভিন্ন দেশের মধ্যে জীবনযাত্রার মানের তুলনা করার জন্য একটি বহুল ব্যবহৃত সূচক। তবে, এটি আয়ের অসমতা বা বৈষম্যকে তুলে ধরে না, যা একটি সীমাবদ্ধতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
৮।মোট দেশজ উৎপাদন (GDP): জিডিপি হলো একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত সকল চূড়ান্ত পণ্য ও সেবার আর্থিক মূল্য। এটি একটি দেশের অর্থনীতির আকার ও প্রবৃদ্ধির একটি প্রাথমিক সূচক। জিডিপি পরিমাপের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা শক্তিশালী এবং এর উৎপাদন ক্ষমতা কেমন। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি।
৯।মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP): জিএনপি হলো একটি দেশের নাগরিকদের দ্বারা উৎপাদিত সকল চূড়ান্ত পণ্য ও সেবার আর্থিক মূল্য, যা দেশের অভ্যন্তরে বা বিদেশে হতে পারে। এটি জিডিপির থেকে ভিন্ন, কারণ এটি নাগরিকত্বের ওপর ভিত্তি করে গণনা করা হয়, ভৌগোলিক সীমানার ওপর নয়। জিএনপি থেকে বোঝা যায় যে, একটি দেশের নাগরিকদের মোট অর্থনৈতিক ক্ষমতা কতটা এবং এটি কীভাবে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত।
১০।খাদ্যশস্যের হিসাব: এই পদ্ধতিটি একটি দেশের জাতীয় আয় পরিমাপে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের মূল্যকে বিশেষভাবে বিবেচনা করে। এটি সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে কৃষি অর্থনীতির একটি বড় অংশ। তবে, শুধু খাদ্যশস্যের ওপর নির্ভর করে জাতীয় আয় পরিমাপ করা হলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেমন শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বাদ পড়ে যায়, যা সামগ্রিক চিত্রকে বিকৃত করতে পারে।
১১।সেবা খাতের হিসাব: আধুনিক অর্থনীতিতে সেবা খাত (যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, পর্যটন) জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ দখল করে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, জাতীয় আয় পরিমাপে সেবা খাতের সকল আয় এবং অবদানকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। একটি উন্নত দেশের অর্থনীতিতে সেবা খাতের অবদান প্রায়শই শিল্প ও কৃষি খাতের চেয়ে বেশি হয়, তাই এর সঠিক পরিমাপ অত্যন্ত জরুরি।
১২।শিল্প খাতের হিসাব: শিল্প খাত একটি দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদিত সকল পণ্যের মূল্যকে জাতীয় আয় গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য, নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্যাস সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত থাকে। একটি দেশের শিল্প খাত যত বেশি উন্নত, তার অর্থনীতি তত বেশি শক্তিশালী হয় এবং এর প্রবৃদ্ধি তত বেশি হয়।
১৩।বিনিয়োগ পদ্ধতি: এই পদ্ধতিটি দেশের মোট বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় আয় পরিমাপ করে। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে মোট দেশজ বিনিয়োগ এবং নিট বিদেশি বিনিয়োগের সমষ্টিকে বোঝায়। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে তার বিনিয়োগের ওপর, কারণ বিনিয়োগ ভবিষ্যতের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই, এই পদ্ধতিটি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়।
১৪।সামাজিক ব্যয়: এই পদ্ধতিটি একটি দেশের মোট সামাজিক ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় আয় পরিমাপ করে। এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পেনশন এবং অন্যান্য সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচির জন্য সরকারের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই ব্যয়গুলো জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে এবং পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
১৫।রপ্তানি ও আমদানি হিসাব: এটি একটি দেশের মোট রপ্তানি এবং আমদানির মধ্যে পার্থক্য (নিট রপ্তানি) ব্যবহার করে জাতীয় আয় পরিমাপ করে। রপ্তানি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে, কারণ এটি দেশের উৎপাদিত পণ্যের জন্য একটি আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি করে। অন্যদিকে, আমদানি দেশের অভ্যন্তর থেকে অর্থ বাইরে নিয়ে যায়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রভাব বোঝা যায়।
উপসংহার: জাতীয় আয় পরিমাপের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলো একে অপরের পরিপূরক। প্রতিটি পদ্ধতির নিজস্ব গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সামগ্রিকভাবে বোঝার জন্য সাধারণত একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। এই পরিমাপগুলো নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সুস্পষ্ট চিত্র তৈরি করে, যা তাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
💰 উৎপাদন পদ্ধতি 💸 আয় পদ্ধতি 💳 ব্যয় পদ্ধতি 📉 নিট জাতীয় আয় 📈 বাজার মূল্যে জাতীয় আয় 🏭 উৎপাদন ব্যয়ে জাতীয় আয় 👨👩👧👦 মাথাপিছু জাতীয় আয় 🏡 মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) 🌍 মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP) 🌾 খাদ্যশস্যের হিসাব ⚕️ সেবা খাতের হিসাব ⚙️ শিল্প খাতের হিসাব 💼 বিনিয়োগ পদ্ধতি 🤝 সামাজিক ব্যয় ✈️ রপ্তানি ও আমদানি হিসাব।
জাতীয় আয়ের ধারণা প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে উপস্থাপিত হয় ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম পেটি’র (William Petty) দ্বারা, ১৬৬৫ সালে। ১৯৩৪ সালে মার্কিন অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটসের (Simon Kuznets) গবেষণায় আধুনিক জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিগুলো বিকশিত হয়। ভারতে, ১৯৪৯ সালে প্রফেসর প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে জাতীয় আয় কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি জাতীয় আয় পরিমাপের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করে। ২০২৫ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৭০% জিডিপি এখন সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল, যা শিল্প বিপ্লবের পর থেকে অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন নির্দেশ করে।

