- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার হলো অর্থনীতির একটি আদর্শ অবস্থা, যেখানে অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা সমজাতীয় পণ্য লেনদেন করে। এই বাজারে কোনো একক ক্রেতা বা বিক্রেতার পক্ষে বাজারের দাম প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। এ কারণেই এই বাজারকে ‘দাম গ্রহীতার বাজার’ বলা হয়, কারণ প্রতিটি ফার্মকে বাজার নির্ধারিত দাম মেনে চলতে হয়।
১।অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা এত বেশি থাকে যে কোনো একক ক্রেতা বা বিক্রেতা বাজারের মোট যোগান বা চাহিদার ক্ষুদ্র একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে, তাদের কেউই বাজারের দাম পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। যদি কোনো ফার্ম দাম বাড়াতে চেষ্টা করে, তবে ক্রেতারা সহজেই অন্য বিক্রেতার কাছে চলে যাবে, কারণ সব পণ্য সমজাতীয়। তাই প্রতিটি বিক্রেতাকে বাজার নির্ধারিত দাম গ্রহণ করতে হয়।
২।সমজাতীয় পণ্য: এই বাজারে সব ফার্ম একই ধরনের পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে, যা গুণগত মান, আকার, বা বৈশিষ্ট্যর দিক থেকে অভিন্ন। ক্রেতাদের কাছে এক বিক্রেতার পণ্য থেকে অন্য বিক্রেতার পণ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। এর ফলে, কোনো বিক্রেতা বেশি দাম নির্ধারণ করলে ক্রেতারা সহজেই অন্য বিক্রেতার কাছে চলে যায়। তাই দামের উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
৩।পূর্ণাঙ্গ তথ্যের সহজলভ্যতা: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কাছে বাজারের দাম, পণ্যের গুণগত মান, এবং অন্যান্য সব তথ্য সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকে। কোনো বিক্রেতা দাম বাড়ালে ক্রেতারা সঙ্গে সঙ্গে তা জানতে পারে এবং কম দামে অন্য বিক্রেতার কাছে চলে যায়। এই তথ্যের স্বচ্ছতা দামের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বাধা দেয়, ফলে ফার্মগুলো কেবল দাম গ্রহণকারী হিসেবে কাজ করে।
৪।যেকোনো সময় বাজারে প্রবেশ ও প্রস্থান: এই বাজারের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো নতুন ফার্মগুলো সহজেই বাজারে প্রবেশ করতে পারে এবং পুরনো ফার্মগুলো সহজে বাজার থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। কোনো ধরনের আইনি বা আর্থিক বাধা এখানে নেই। যদি কোনো ফার্ম অতিরিক্ত লাভ করে, তবে নতুন ফার্ম আকৃষ্ট হয়ে বাজারে প্রবেশ করবে, যা যোগান বাড়িয়ে দাম কমিয়ে দেবে। একইভাবে, যদি লোকসান হয়, তবে ফার্মগুলো বাজার ত্যাগ করবে। এই অবাধ প্রবেশ ও প্রস্থান দামকে স্থিতিশীল রাখে।
৫।স্বল্প মুনাফার প্রবণতা: দীর্ঘমেয়াদে, পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ফার্মগুলো কেবল স্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করে। যদি কোনো ফার্ম অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করে, তবে তা নতুন ফার্মকে আকৃষ্ট করে। নতুন ফার্মের আগমনে বাজারে যোগান বাড়ে এবং দাম কমে যায়, যার ফলে মুনাফা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসে। এটি প্রমাণ করে যে কোনো ফার্মের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
৬।শূন্য বিজ্ঞাপন ব্যয়: যেহেতু এই বাজারে সব পণ্য অভিন্ন এবং ক্রেতাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকে, তাই বিক্রেতাদের বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার প্রয়োজন পড়ে না। বিজ্ঞাপন খরচ করে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই, কারণ ক্রেতারা বেশি দামের পণ্য কিনবে না। এর ফলে, উৎপাদন খরচ কম থাকে এবং দামের উপর কোনো বিক্রেতার প্রভাব থাকে না।
৭।স্বতন্ত্র ফার্মের ক্ষুদ্র আকার: এই বাজারে প্রতিটি ফার্মের আকার এত ছোট যে তাদের একক উৎপাদন বাজারের মোট যোগানের তুলনায় নগণ্য। কোনো ফার্ম যদি তার উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে বন্ধও করে দেয়, তা বাজারের মোট যোগান বা দামে কোনো পরিবর্তন আনবে না। এটি পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয় যে প্রতিটি ফার্মকে বাজার নির্ধারিত দাম মেনে নিতে হয়।
৮।সামগ্রিক বাজার চাহিদা ও যোগান দ্বারা নির্ধারিত দাম: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দাম কোনো একক ফার্ম দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং সামগ্রিক বাজার চাহিদা ও যোগানের পারস্পরিক ক্রিয়ায় নির্ধারিত হয়। অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্মিলিত কার্যকলাপের ফলে একটি ভারসাম্য দাম সৃষ্টি হয়, যা প্রতিটি ফার্মকে মেনে নিতে হয়। এ কারণেই এই বাজারকে ‘দাম গ্রহীতার বাজার’ বলা হয়।
৯।দামের উপর একচেটিয়া প্রভাবের অনুপস্থিতি: এই বাজারে কোনো একক বিক্রেতা বা বিক্রেতার দল নেই যারা একচেটিয়াভাবে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একচেটিয়া বাজারে বিক্রেতা নিজেই দাম নির্ধারণ করে, কিন্তু এখানে অসংখ্য বিক্রেতা থাকায় সেই সুযোগ নেই। প্রতিটি বিক্রেতাকেই বাজার দ্বারা নির্ধারিত দাম মেনে চলতে হয়।
১০।সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণহীনতা: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দ্বারা দাম বা উৎপাদনের উপর কোনো হস্তক্ষেপ থাকে না। বাজারের চাহিদা ও যোগানের স্বাভাবিক শক্তিই দাম নির্ধারণ করে। এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবস্থা, যেখানে কোনো বাহ্যিক শক্তি দাম নিয়ন্ত্রণ করে না, ফলে প্রতিটি বিক্রেতা কেবল দাম গ্রহণকারী হিসেবে কাজ করে।
১১।অবাধ চলাচলের সুবিধা: উৎপাদনের উপকরণ, যেমন শ্রম ও মূলধন, এই বাজারে অবাধে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করতে পারে। যদি কোনো স্থানে বেশি লাভ হয়, তবে উপকরণগুলো দ্রুত সেখানে চলে যাবে। এর ফলে, বাজারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং দাম কমে যাবে। এই অবাধ চলাচল দামকে স্থিতিশীল রাখে এবং কোনো ফার্মকে দাম বাড়ানোর সুযোগ দেয় না।
১২।সীমাহীন সরবরাহ: দীর্ঘমেয়াদে, পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যদি দাম বাড়ে, তবে নতুন ফার্মের আগমনের কারণে সরবরাহ প্রায় সীমাহীনভাবে বাড়ানো সম্ভব। এর ফলে, বাড়তি দাম কমে যায় এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই সীমাহীন সরবরাহ ক্ষমতা কোনো বিক্রেতাকে দামের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না।
১৩।যোগান ও চাহিদার ভারসাম্য: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যোগান এবং চাহিদার ভারসাম্য খুব দ্রুত অর্জিত হয়। যদি কোনো কারণে যোগান বাড়ে বা কমে, তবে দামও সে অনুযায়ী পরিবর্তিত হয় যতক্ষণ না নতুন ভারসাম্য অর্জিত হয়। এই ভারসাম্য অবস্থায় প্রতিটি ফার্মকে বাজার নির্ধারিত দাম মেনে চলতে হয়, কারণ তারা নিজেরাই দাম পরিবর্তন করতে পারে না।
১৪।একক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ: এই বাজারে প্রতিটি ফার্মের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। একটি ফার্ম তার উৎপাদন বাড়াতে পারে, কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত বাজারের মোট যোগান বা দামে কোনো প্রভাব ফেলবে না। সুতরাং, ফার্মের নিজের সিদ্ধান্ত বাজারের দামকে প্রভাবিত করতে পারে না, তাই তাকে কেবল বাজার নির্ধারিত দাম গ্রহণ করতে হয়।
১৫।মূল্য স্থিতিশীলতার প্রবণতা: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দাম সাধারণত স্থিতিশীল থাকে। অবাধ প্রবেশ ও প্রস্থান, পূর্ণাঙ্গ তথ্যের সহজলভ্যতা এবং অসংখ্য ক্রেতা-বিক্রেতার কারণে যেকোনো দামের পরিবর্তন খুব দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এটি দেখায় যে কোনো ফার্মের পক্ষে দামের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা সম্ভব নয়।
উপসংহার: পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারকে ‘দাম গ্রহীতার বাজার’ বলার মূল কারণ হলো এই বাজারের অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা, সমজাতীয় পণ্য, এবং অবাধ প্রবেশ ও প্রস্থানের মতো মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে কোনো একক ফার্ম বা ক্রেতা বাজারের দাম প্রভাবিত করতে পারে না। সামগ্রিক বাজারের চাহিদা ও যোগানই দাম নির্ধারণ করে, যা প্রতিটি ফার্মকে মেনে নিতে হয়। তাই এই বাজারকে অর্থনীতির একটি আদর্শ অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে দামের উপর কোনো একচেটিয়া প্রভাব থাকে না।
১. অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা ২. সমজাতীয় পণ্য ৩. পূর্ণাঙ্গ তথ্যের সহজলভ্যতা ৪. যেকোনো সময় বাজারে প্রবেশ ও প্রস্থান ৫. স্বল্প মুনাফার প্রবণতা ৬. শূন্য বিজ্ঞাপন ব্যয় ৭. স্বতন্ত্র ফার্মের ক্ষুদ্র আকার ৮. সামগ্রিক বাজার চাহিদা ও যোগান দ্বারা নির্ধারিত দাম ৯. দামের উপর একচেটিয়া প্রভাবের অনুপস্থিতি ১০. সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণহীনতা ১১. অবাধ চলাচলের সুবিধা ১২. সীমাহীন সরবরাহ ১৩. যোগান ও চাহিদার ভারসাম্য ১৪. একক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ১৫. মূল্য স্থিতিশীলতার প্রবণতা।
পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ধারণাটি ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অর্থনৈতিক তত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অ্যাডাম স্মিথ তার ১৭৭৬ সালের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস’-এ অদৃশ্য হাতের (Invisible Hand) ধারণা দেন, যা মূলত এই ধরনের বাজারের স্বতঃস্ফূর্ত কার্যকলাপকে বোঝায়। ১৯শ শতাব্দীতে আলফ্রেড মার্শালের মতো অর্থনীতিবিদরা এই ধারণাকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। যদিও বাস্তব বিশ্বে বিশুদ্ধ পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার খুব কমই দেখা যায়, এর ধারণাটি বিভিন্ন অর্থনৈতিক মডেল এবং নীতি নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কিছু কৃষি পণ্য বা অনলাইন নিলাম বাজারের মতো ক্ষেত্রগুলোতে এই মডেলের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় যে, অধিকাংশ শিল্প বাজার পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক মডেলের চেয়ে অলিগোপলি বা একচেটিয়া প্রতিযোগিতামূলক মডেলের কাছাকাছি।

