- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা:- দুর্নীতি একটি ক্যান্সার স্বরূপ যা ধীরে ধীরে একটি সমাজকে কুরে কুরে খায়। বাংলাদেশে এই ব্যাধি প্রকট আকার ধারণ করেছে, যার শিকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত। ব্যক্তিগত লোভ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইনের শাসনের দুর্বলতা এই দুর্নীতিকে লালন করে। এর ফলস্বরূপ, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, সামাজিক বৈষম্য বাড়ে এবং সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আসুন, বাংলাদেশের দুর্নীতির কারণ ও এর ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
১.রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব: বাংলাদেশে দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বল সদিচ্ছা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্নীতির ব্যাপকতা বাংলাদেশে সুশাসনের অভাবের একটি বড় নির্দেশক। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে।
২.আইনের শাসনের দুর্বলতা: আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা দুর্নীতিবাজদের শাস্তি এড়িয়ে যেতে সাহায্য করে। দুর্বল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ায় দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের রুল অফ ল ইনডেক্স ২০২৩-এ বাংলাদেশের অবস্থান নিম্ন সারিতে থাকা আইনের শাসনের দুর্বলতারই প্রতিফলন।
৩.প্রশাসনের অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব: সরকারি দপ্তরগুলোতে কাজের স্বচ্ছতা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অভাব ব্যাপক দুর্নীতির জন্ম দেয়। তথ্য অধিকার আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং জনগণের কাছে তথ্য প্রদানে অনীহা প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের বাস্তবায়নে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রায়শই আর্থিক অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি করে।
৪.ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও অপব্যবহার: ক্ষমতার अत्यधिक কেন্দ্রীকরণ এবং তার অপব্যবহার দুর্নীতির একটি বড় উৎস। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। এর ফলে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে।
৫.অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য: বাংলাদেশে বিদ্যমান চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং দারিদ্র্য অনেক মানুষকে দুর্নীতিতে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। অভাবের তাড়নায় মানুষ সামান্য অর্থের লোভে নীতি ও নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করে না। এছাড়া, ধনী ও প্রভাবশালীরা তাদের আর্থিক ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্নীতিকে আরও বিস্তার করে।
৬.শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব: জনগণের মধ্যে দুর্নীতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবও একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে অসচেতন থাকার কারণে অনেকেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দ্বিধা করেন। এছাড়া, শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার দুর্বলতাও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায়, যা দুর্নীতিকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে।
৭.সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ এবং নীতি-নৈতিকতার অভাব দুর্নীতি বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ব্যক্তিগত লোভ, দ্রুত ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং অন্যের সম্পদ দখলের মানসিকতা সমাজে প্রকট আকার ধারণ করেছে। পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের দুর্বলতা এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
৮.সুযোগের অভাব ও বেকারত্ব: কর্মসংস্থানের অভাব এবং অর্থনৈতিক সুযোগের সীমিততা অনেক শিক্ষিত যুবককে হতাশ করে তোলে। এই পরিস্থিতিতে, অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রলোভন তাদের দুর্নীতিতে আকৃষ্ট করতে পারে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিও যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে এবং হতাশা বাড়ায়।
৯.বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের অব্যবহার: বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সাহায্য ও ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় না। দুর্বল তদারকি এবং জবাবদিহিতার অভাবে এই অর্থের একটি বড় অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পকেটে চলে যায়।
১০.ঠিকাদারী ও নির্মাণ খাতের দুর্নীতি: বাংলাদেশের ঠিকাদারী ও নির্মাণ খাত দুর্নীতির অন্যতম উর্বর ক্ষেত্র। সরকারি প্রকল্পের অনুমোদন, দরপত্র প্রক্রিয়া এবং কাজের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক অনিয়ম দেখা যায়। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং জনগণের অর্থ অপচয় হয়।
১১.ভূমি ও রাজস্ব খাতের দুর্নীতি: ভূমি দখল, জাল দলিল তৈরি এবং রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে অহরহ ঘটে। ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে এই দুর্নীতি সংঘটিত হয়, যা সাধারণ মানুষের হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১২. ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি: ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে ঋণ জালিয়াতি, অর্থ পাচার এবং খেলাপি ঋণের পাহাড় দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্বল তদারকির কারণে এই খাতে দুর্নীতিবাজরা সহজেই পার পেয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে এই খাতের দুর্বল চিত্র উঠে এসেছে।
১৩.কাস্টমস ও শুল্ক বিভাগের দুর্নীতি: কাস্টমস ও শুল্ক বিভাগে মিথ্যা ঘোষণা, চোরাচালান এবং ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতি সংঘটিত হয়। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায় এবং অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করে।
১৪.স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের দুর্নীতি: স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাখাতেও দুর্নীতির বিস্তার লক্ষণীয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিম্নমানের ঔষধ সরবরাহ, নিয়োগে অনিয়ম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়।
১৫.স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি: স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া বিল তৈরি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটিত হয়। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে না।
১৬.তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার: তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে এই খাতকে ব্যবহার করেও দুর্নীতির নতুন নতুন কৌশল তৈরি হয়েছে। অনলাইন জালিয়াতি, ডেটা চুরি এবং সরকারি ওয়েবসাইটে অবৈধ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে।
১৭.দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা: বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের কার্যকারিতা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও জনবলের অভাব এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রম নিয়েও বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে।
১৮.আন্তর্জাতিক প্রভাব: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থ পাচার এবং বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডও বাংলাদেশের দুর্নীতি পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে। অবৈধ আর্থিক লেনদেন এবং কর ফাঁকির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়।
১৯.গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা: অবাধ ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে গণমাধ্যমের উপর বিভিন্ন ধরনের চাপ এবং নিয়ন্ত্রণ থাকায় অনেক সময় দুর্নীতি সংক্রান্ত তথ্য জনগণের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারে না।
২০.নাগরিক সমাজের দুর্বল ভূমিকা: দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের দুর্বলতা এবং তাদের কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা দুর্নীতি প্রতিরোধে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারছে না।
২১.দ্রুত ধনী হওয়ার মানসিকতা: সমাজে রাতারাতি ধনী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং ভোগবাদী মানসিকতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে দ্রুত অর্থ উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা অনেককে অবৈধ পথে চালিত করে।
উপসংহার:- পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা যার গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থেকে শুরু করে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় পর্যন্ত বিভিন্ন কারণ এই দুর্নীতিকে জিইয়ে রেখেছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে এবং সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের শাসনের দুর্বলতা, প্রশাসনের অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও অপব্যবহার, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সুযোগের অভাব ও বেকারত্ব, বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের অব্যবহার, ঠিকাদারী ও নির্মাণ খাতের দুর্নীতি, ভূমি ও রাজস্ব খাতের দুর্নীতি, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি, কাস্টমস ও শুল্ক বিভাগের দুর্নীতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের দুর্নীতি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার, দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, আন্তর্জাতিক প্রভাব, গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা, নাগরিক সমাজের দুর্বল ভূমিকা এবং দ্রুত ধনী হওয়ার মানসিকতা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের দুর্নীতির স্কোর ২৬ (১০০-এর মধ্যে)। ২০২১ সালে দুদকের মামলার মধ্যে মাত্র ৩২% রায় হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর জন্য ১৯টি ধাপ পেরোতে হয়। ২০২১ সালে ৩০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বিবিএস-২০২৩ অনুযায়ী, ২৪% যুবক বেকার। আইএমএফের তথ্যমতে, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বছরে ২% জিডিপি হারায়।

