- readaim.com
- 0

উত্তর::উপস্থাপনা:- দুর্নীতি, একটি ক্যান্সার যা ধীরে ধীরে একটি সমাজকে কুরে কুরে খায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এই বিষাক্ত ছোবল অনুভূত হয় প্রতিনিয়ত। উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় এই দুর্নীতি, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে বিস্তার লাভ করেছে। সরকারি দপ্তর থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত লেনদেন পর্যন্ত, দুর্নীতির কালো ছায়া সবকিছুকে কলুষিত করে তোলে। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের বিভিন্ন দিক এবং এর চ্যালেঞ্জগুলো আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। আসুন, আমরা এই জাতীয় ব্যাধির গভীরে প্রবেশ করি এবং এর মোকাবিলার উপায়গুলো সন্ধান করি।
১.আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগে দুর্বলতা:- বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান বাধা হলো আইনের শাসনের দুর্বল প্রয়োগ। দুর্নীতিবাজরা প্রায়শই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় অথবা লঘু শাস্তি পায়। এর মূল কারণ হলো রাজনৈতিক প্রভাব, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত সক্ষমতার অভাব। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে দুর্নীতি একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
২.সরকারি প্রতিষ্ঠানে অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব:- সরকারি দপ্তরগুলোতে প্রায়শই অস্বচ্ছতা দেখা যায়। বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ, নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতার অভাব দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে। জবাবদিহিতার অভাবের কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে না, যা দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করে।
৩.রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব:- দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী একটি শক্তিশালী ঐক্যমতের অভাব এবং দুর্নীতিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
৪.দুর্বল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক):- বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রধান সংস্থা হলো দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে দুদক তার কার্যকারিতা পুরোপুরিভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। জনবল সংকট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা না থাকার কারণে অনেক বড় দুর্নীতিবাজও দুদকের আওতার বাইরে থেকে যায়।
৫.জনগণের অসচেতনতা ও নিষ্ক্রিয়তা:- দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি এবং এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই জনগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে ভয় পায় অথবা এটিকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেয়। জনগণের এই অসচেতনতা ও নিষ্ক্রিয়তা দুর্নীতিবাজদের আরও উৎসাহিত করে।
৬.অর্থ পাচার ও বিদেশে অবৈধ সম্পদ:- দুর্নীতি করে অর্জিত অর্থ প্রায়শই বিদেশে পাচার করা হয়। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্নীতিবাজরা আরও শক্তিশালী হয়। অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দুর্বলতা এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে তোলে।
৭.ভূমি ও রাজস্ব খাতে দুর্নীতি:- ভূমি দখল, ভুয়া দলিল তৈরি এবং রাজস্ব ফাঁকির মতো দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। এই খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা দুর্নীতির বিস্তার ঘটায়। এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়।
৮.ক্রয় ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি:- সরকারি কেনাকাটা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি দেখা যায়। সিন্ডিকেট তৈরি করে অথবা যোগসাজশের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেওয়া হয়, যেখানে পণ্যের গুণগত মান এবং সরকারের আর্থিক ক্ষতি উপেক্ষা করা হয়। এই দুর্নীতি সরকারি অর্থের অপচয় ঘটায়।
৯.শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি:- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এই খাতে স্বচ্ছতা ও নজরদারির অভাব দুর্নীতিবাজদের সুযোগ করে দেয়।
১০.ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দুর্নীতির বিস্তার:- প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও দুর্নীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। অনলাইন জালিয়াতি, ডেটা চুরি এবং সাইবার অপরাধের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই ধরনের দুর্নীতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সক্ষমতার অভাব রয়েছে।
শেষের বাণী:- বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যার শিকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত। এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
একনজরে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের উপাত্তসমূহ
📌 ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের CPI সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৫ (২০২৩)।
📌 দুদক ২০২২ সালে ১,৫০০ এর বেশি মামলা দায়ের করে।
📌 ই-গভর্নেন্সের মাধ্যমে ঘুষের হার ৩০% কমেছে (২০২১)।
📌 বিশ্বব্যাংকের মতে, ব্যবসায়িক খাতে দুর্নীতির হার ৫৬% (২০২০)।
📌 UNDP-এর প্রশিক্ষণে ৫০০ কর্মকর্তা অংশ নেয় (২০২১)।
📌 ৬৫% যুবক দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে চায় (২০২৩)।
বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন জরিপ ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের ডাটা অনুসারে, সরকারি সেবা নেওয়ার সময় ৭২% নাগরিক ঘুষের সম্মুখীন হয়। তবে ২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ই-গভর্নেন্সের প্রসার ও দুদকের কার্যক্রমে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।