- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: দ্বি-জাতি তত্ত্ব হলো ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ধারণা, যা অনুযায়ী ভারতীয় জনগণ দুটি প্রধান জাতিতে বিভক্ত—হিন্দু ও মুসলমান। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য ছিল যে এই দুই প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় তারা একক রাষ্ট্রে সহাবস্থান করতে পারে না। এই ধারণাই পরবর্তীতে ভারত বিভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষলগ্নে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
দ্বি-জাতি তত্ত্ব উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই তত্ত্বের মূল প্রবক্তা ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান, তবে এর পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক রূপ দেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এই মতবাদ অনুযায়ী, ধর্মীয় পার্থক্য কেবল উপাসনার পদ্ধতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা দুটি জাতির সম্পূর্ণ জীবনযাত্রাকেই প্রভাবিত করেছিল। জিন্নাহ দৃঢ়ভাবে প্রচার করেন যে হিন্দু এবং মুসলমানরা কেবল দুটি ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, বরং তারা দুটি স্বতন্ত্র জাতি। তাদের ভাষা, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন।
তত্ত্বটির প্রধান যুক্তি ছিল এই যে, একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর অধীনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দুর্বল ও বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাদের আশঙ্কা ছিল যে গণতন্ত্রের নিয়মে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানরা চিরস্থায়ীভাবে সংখ্যালঘু হিসেবে থাকবে এবং তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে না। তাই, মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য ছিল, যেখানে তারা নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে স্বাধীনভাবে লালন করতে পারবে। এই তত্ত্বই ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত হয় এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজন ঘটিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। যদিও দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হলেও, পরে এর পূর্বাংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) আবার একাত্তরে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে স্বাধীন হয়ে প্রমাণ করে যে ধর্মের ভিত্তিতে জাতিসত্তা স্থায়ী হয় না।
উপসংহার: দ্বি-জাতি তত্ত্ব ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক পরিবর্তনকারী শক্তি, যা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বিশাল ভূখণ্ডের বিভাজন ঘটিয়েছিল। এই তত্ত্বের ফলস্বরূপ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও, এর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব আজও বিদ্যমান। যদিও এই তত্ত্ব বহুলাংশে বিতর্কিত এবং এর বিভাজনকারী পরিণতির জন্য সমালোচিত, তবুও এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রের অন্যতম প্রধান নির্ণায়ক। এটি ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদ ও জাতিসত্তার সংজ্ঞায় ধর্মের ভূমিকা স্পষ্ট করে তোলে।

