- readaim.com
- 0

উত্তর::সূচনা:- নদী তীরবর্তী সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর একটি। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নদী তীরবর্তী এলাকায় বাস শুরু করেছিল, কারণ নদী মানুষের জীবনযাত্রায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছিল। নদী ছিল যোগাযোগের মাধ্যম, জলচাষের উৎস, খাদ্য সংগ্রহের স্থান এবং পরিবহন ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নদী তীরবর্তী সভ্যতার পরিচয়:-
‘নদী তীরবর্তী সভ্যতা’ বলতে এমন একটি সভ্যতাকে বোঝায় যা প্রধানত নদী বা জলধারার আশেপাশে গড়ে উঠেছে এবং যে নদী সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নদী তীরবর্তী সভ্যতাগুলি মানব ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সভ্যতা গড়ে ওঠার জন্য নদী একটি অত্যন্ত উপযোগী স্থান ছিল, যেখানে কৃষি, বাণিজ্য, এবং শিল্পের বিকাশ সহজেই সম্ভব হত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (Tigris এবং Euphrates নদী), ভারত উপমহাদেশ (ইন্দুস এবং গঙ্গা নদী), এবং মিশর (নীল নদী) নদী তীরবর্তী সভ্যতার উদাহরণ।
সাধারণ ভাষায়:- আমরা নদী তীরবর্তী সভ্যতাকে সাধারণত সেইসব সভ্যতা হিসেবে চিন্তা করি যেগুলি নদী বা জলধারার কাছে গড়ে উঠেছে এবং সেখানে মানুষের জীবনযাত্রা নদীর উপর নির্ভরশীল ছিল। এই সভ্যতাগুলি কৃষি, বাণিজ্য, এবং সংস্কৃতির বিকাশের জন্য নদীকে অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
১।গোল্ডস্টাইন (Goldstein) বলেছেন, “নদী তীরবর্তী সভ্যতা একটি উন্নত সমাজ যা নদীর তীরবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে এবং যে নদী মানব জীবন ও সংস্কৃতির বিকাশে সহায়ক হয়েছে।”
২।ডেভিড হোল (David Hole) বলেছেন, “এমন একটি সভ্যতা যা নদীর সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত এবং সেখানে মানব সভ্যতা গড়ে ওঠে।”
৩।উলফগাং অডাম (Wolfgang Adam) বলেছেন, “নদী তীরবর্তী সভ্যতা এমন একটি সামাজিক কাঠামো যা নদীকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে।” (Wolfgang Adam, River-centered Civilization)
৪।রবার্ট টেলর (Robert Taylor) বলেছেন, “নদী তীরবর্তী সভ্যতা মানুষের জীবনধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে নদী কৃষি ও জলসম্পদের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়।”
৫।চম্পা সিং (Champa Singh) বলেছেন, “নদী তীরবর্তী সভ্যতায় নদী শুধু শখ বা উপভোগ্য নয়, এটি জীবনের চাহিদা পূরণের জন্য অপরিহার্য।”
৬।সুজাতা মিত্র (Sujata Mitra) বলেছেন, “নদী তীরবর্তী সভ্যতা মানব সভ্যতার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে।”
৭।ড. সেলিম খান (Dr. Selim Khan) বলেছেন, “নদী তীরবর্তী সভ্যতার বিকাশ নদী দ্বারা প্রভাবিত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার থেকেই শুরু হয়েছে।”
৮।আর্নল্ড টয়নবি বলেছেন, “নদী তীরবর্তী সভ্যতা হলো প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে গড়ে ওঠা একটি স্থায়ী মানবসমাজ।” (“Riverine civilizations are permanent human societies that utilize natural resources.”)
৯।হেরোডোটাস বলেছেন, “মিশর হলো নীল নদের দান, কারণ নদী ছাড়া এখানে কোনো সভ্যতা গড়ে উঠত না।” (“Egypt is the gift of the Nile, as without the river, no civilization would have flourished here.”)
উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, নদী তীরবর্তী সভ্যতা হলো সেই মানব সমাজ যা জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রধানত কোনো একটি নদীর উপর নির্ভরশীল এবং নদীর তীরকে কেন্দ্র করে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। এই সভ্যতাগুলোর উন্নতি প্রায়শই নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, উর্বর ভূমি এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
উপসংহার:- নদী তীরবর্তী সভ্যতাগুলি মানব ইতিহাসে একটি অমূল্য অবদান রেখেছে। এই সভ্যতাগুলির বেঁচে থাকার জন্য নদী এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল, যা শুধুমাত্র যোগাযোগ ও কৃষির জন্য নয়, বরং মানব সভ্যতার বিকাশের জন্যও অপরিহার্য ছিল। নদী তীরবর্তী সভ্যতাগুলির মাধ্যমে আমরা আজকের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পারি।
“নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা উন্নত মানবসমাজই হলো নদী তীরবর্তী সভ্যতা।”
প্রাচীন বিশ্বের চারটি প্রধান নদী তীরবর্তী সভ্যতা হলো—
- ১. সিন্ধু সভ্যতা (৩৩০০–১৩০০ খ্রিস্টপূর্ব, সিন্ধু নদ),
- ২. মেসোপটেমিয়া (৩৫০০–৫০০ খ্রিস্টপূর্ব, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস),
- ৩. মিশরীয় সভ্যতা (৩১০০–৩০ খ্রিস্টপূর্ব, নীল নদ),
- ৪. হোয়াংহো সভ্যতা (২০০০ খ্রিস্টপূর্ব, হোয়াংহো নদী)।
২০১৯ সালের জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ৬০% প্রাচীন শহর নদীতীরে গড়ে উঠেছে। এছাড়া, ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান বিশ্বের ৮০% বড় শহরও নদীর কাছাকাছি অবস্থিত। নদী তীরবর্তী সভ্যতাগুলোই প্রথম লিখন পদ্ধতি, আইন ও গণিতের বিকাশ ঘটিয়েছিল, যা আজও মানবসভ্যতাকে প্রভাবিত করছে।