- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: যুগে যুগে নারীর প্রতি সহিংসতা এক গভীর সামাজিক ব্যাধি হিসেবে সমাজে বিদ্যমান। এটি শুধু নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনই করে না, বরং সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতি ও শান্তিতেও বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের চারপাশে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এই সহিংসতার পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ, যা আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রোথিত। আসুন, সেই কারণগুলো সহজভাবে আলোচনা করা যাক।
১.পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার :- সমাজে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা নারীর প্রতি সহিংস আচরণের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এই মানসিকতা পুরুষদেরকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে মনে করে। ফলস্বরূপ, পুরুষরা তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য নারীর উপর শারীরিক, মানসিক বা অর্থনৈতিক নিপীড়ন চালায়। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত, সর্বত্রই এই ক্ষমতার অপব্যবহার নারীর প্রতি সহিংসতার জন্ম দেয়।
২.সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথা :- অনেক সমাজে এমন কিছু প্রথা ও রীতিনীতি প্রচলিত আছে যা নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসাহিত করে। যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর সীমিত অধিকার, এবং পারিবারিক সম্মান রক্ষার নামে নারীর স্বাধীনতা হরণ—এগুলো নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন রূপ। এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথাগুলো নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে স্বাভাবিক করে তোলে এবং সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন করে দেয়।
৩.অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা :- আর্থিক ক্ষেত্রে নারীর দুর্বলতা বা পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা অনেক সময় নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন একজন নারী অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হন, তখন তিনি অনেক ক্ষেত্রে অপমানজনক বা সহিংস আচরণ সহ্য করতে বাধ্য হন। নিজের বা সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য তিনি প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এবং সহিংস পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে।
৪.শিক্ষার অভাব ও সচেতনতার অভাব :- শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম হাতিয়ার। শিক্ষার অভাবে নারী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে না এবং অনেক সময় সহিংসতাকে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নেয়। অন্যদিকে, পুরুষেরাও সঠিক শিক্ষার অভাবে নারীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতে শেখে না। সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষার প্রসার এবং নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অত্যন্ত জরুরি।
৫.আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি :- নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে তার সঠিক প্রয়োগ দেখা যায় না। অপরাধীরা সহজেই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় বা লঘু শাস্তি পায়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের আরও উৎসাহিত করে এবং ভুক্তভোগী নারীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গত বিচার নিশ্চিত করা সহিংসতারোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
৬.মাদকদ্রব্যের প্রভাব :- মাদকদ্রব্যের ব্যবহার অনেক সময় মানুষকে বিবেকহীন ও আগ্রাসী করে তোলে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পুরুষরা তাদের সঙ্গিনী বা পরিবারের অন্য নারী সদস্যদের উপর সহিংস আচরণ করতে পারে। মাদকাসক্তির কারণে পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি পায় এবং নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা নিয়ন্ত্রণ এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
৭.গণমাধ্যমের নেতিবাচক ভূমিকা :- কিছু গণমাধ্যম নারীর প্রতি নেতিবাচক ও stereotypic ধারণা প্রচার করে, যা সমাজে নারীর প্রতি অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, কিছু চলচ্চিত্রে বা অনুষ্ঠানে নারীকে দুর্বল ও ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা পুরুষদের মধ্যে নারীর প্রতি অসম্মানজনক মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে। গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে সহায়ক হতে পারে।
৮.মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা :- কিছু ক্ষেত্রে, পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন—অতিরিক্ত রাগ, হতাশা, বা ব্যক্তিত্বের विकार—নারীর প্রতি সহিংস আচরণের কারণ হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করা সহিংসতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা মানেই কেউ সহিংস হবে—এমন ধারণা ভুল।
৯.সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘাত :- সামাজিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য, এবং জাতিগত বা ধর্মীয় সংঘাতের সময় নারীর প্রতি সহিংসতার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং নারীরা আরও অরক্ষিত হয়ে পড়েন। স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।
১০.পারিবারিক কলহ ও সম্পর্কের অবনতি :- পারিবারিক কলহ এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি অনেক সময় সহিংসতার রূপ নেয়। ভুল বোঝাবুঝি, অর্থনৈতিক চাপ, বা অন্য কোনো কারণে সৃষ্ট তিক্ততা থেকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু হতে পারে। পারস্পরিক সম্মান ও আলোচনার মাধ্যমে পারিবারিক সমস্যা সমাধানের গুরুত্ব উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
১১.সামাজিক কুসংস্কার :- “স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা পাপ নয়”—এমন ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত। বিয়েতে যৌতুক, বাল্যবিবাহ ও গোঁড়ামি নারীর উপর অত্যাচারকে উৎসাহিত করে। কুসংস্কার দূর করতে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।
১২.আইনের দুর্বল প্রয়োগ :- নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে আইন থাকলেও তা ঠিকমতো প্রয়োগ হয় না। অনেক সময় পুলিশ, আদালত ও সমাজের লোকেরা বিষয়টিকে পাত্তা দেয় না। দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার:- নারীর প্রতি সহিংসতা একটি জটিল সমস্যা যার মূলে রয়েছে বহুবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ। এই সমস্যার সমাধানে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন, আইনের কঠোর প্রয়োগ, শিক্ষার প্রসার, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই একটি সহিংসতামুক্ত সমাজ নির্মাণ করা সম্ভব। আসুন, আমরা সবাই মিলে নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করি।
⚡ এক নজরে নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণসমূহ:-
♂️ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা – নারীকে অধীনস্থ ভাবার সংস্কৃতি
💸 অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা – আয় না থাকায় নির্যাতন সহ্য
📚 শিক্ষার অভাব – অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা
👹 সামাজিক কুসংস্কার – “স্ত্রী মারধর অধিকার” এর মতো ভ্রান্ত ধারণা
⚖️ আইনের দুর্বল প্রয়োগ – মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও শাস্তিহীনতা
💊 মাদক ও অস্ত্রের ব্যবহার – সহিংসতাকে তীব্র করা
📱 প্রযুক্তির অপব্যবহার – সাইবার হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইল
💔 পারিবারিক কলহ – বিচ্ছেদকালীন প্রতিশোধমূলক আচরণ
🏛️ রাজনৈতিক বৈষম্য – নারীর প্রতিনিধিত্বের অভাব
🧠 মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা – রাগ নিয়ন্ত্রণহীনতা
বাংলাদেশে ২০২২ সালের আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী নির্যাতনের ৪০% মামলায় আসামিরা শাস্তি এড়িয়ে যায়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC)-এর জরিপে দেখা গেছে, ৬৮% নারী পুলিশ থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন। ইউএনডিপি-এর মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় নারী সহিংসতা মামলার নিষ্পত্তি গড়ে ৩-৫ বছর সময় নেয়। আইনের সঠিক প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এই সংকট কাটানো সম্ভব নয়।

