- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং জনকল্যাণমূলক কাজে অর্থ সংগ্রহের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করে। এই কর ব্যবস্থা মূলত দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত—প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ কর। যদিও উভয় প্রকার করই সরকারের আয়ের উৎস, তাদের প্রকৃতি, আদায় পদ্ধতি, এবং জনসাধারণের উপর তাদের প্রভাবের দিক থেকে এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই দুটি করের পার্থক্য বোঝা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং প্রতিটি নাগরিকের উপর করের প্রভাব সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দেয়।
১। প্রকৃতি: প্রত্যক্ষ কর সরাসরি ব্যক্তির আয় বা সম্পত্তির উপর ধার্য করা হয়। এই করের বোঝা সেই ব্যক্তিকেই বহন করতে হয় যার উপর এটি আরোপ করা হয়েছে। যেমন—আয়কর। অন্যদিকে, পরোক্ষ কর পণ্য বা সেবার উপর ধার্য করা হয়, এবং এর বোঝা সরাসরি বহন করে সেই ব্যক্তি যে ওই পণ্য বা সেবা কেনে। যেমন—মূল্য সংযোজন কর (VAT) বা পরিষেবা কর। এই করের ক্ষেত্রে, করের বোঝা বিক্রেতা থেকে ক্রেতার উপর স্থানান্তরিত হয়।
২। আদায় প্রক্রিয়া: প্রত্যক্ষ কর সাধারণত সরকারের মনোনীত কর বিভাগ সরাসরি করদাতার কাছ থেকে সংগ্রহ করে। করদাতা নিজেই তার আয় বা সম্পদের উপর ভিত্তি করে এই কর পরিশোধ করে। পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে, কর আদায় করে মূলত সেইসব ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান যারা পণ্য ও সেবা বিক্রি করে। এরপর তারা সেই সংগৃহীত কর সরকারের কাছে জমা দেয়। সাধারণ মানুষ পণ্য বা সেবা কেনার সময়ই এই কর পরিশোধ করে।
৩। করের বোঝা: প্রত্যক্ষ করের বোঝা স্থানান্তরিত করা যায় না। অর্থাৎ, যার উপর কর ধার্য করা হয়, তাকেই সেই কর দিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তির আয়কর তার পরিবর্তে অন্য কেউ দিতে পারে না। এর বিপরীতে, পরোক্ষ করের বোঝা স্থানান্তরযোগ্য। যেমন, কোনো বিক্রেতা পণ্যের উপর আরোপিত কর দামের সাথে যুক্ত করে দেয়, ফলে এর বোঝা শেষ পর্যন্ত ক্রেতার উপর বর্তায়।
৪। সাম্য নীতি: প্রত্যক্ষ কর সাধারণত সাম্য নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি। অর্থাৎ, যাদের আয় বেশি, তাদের উপর উচ্চ হারে কর ধার্য করা হয়, এবং যাদের আয় কম, তাদের উপর কম হারে বা কোনো করই ধার্য করা হয় না। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পায়। পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে এই নীতি কার্যকর হয় না। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই একই পণ্য কেনার সময় একই পরিমাণ কর দেয়। ফলে এটি গরিবের উপর তুলনামূলকভাবে বেশি চাপ সৃষ্টি করে।
৫। অর্থনৈতিক প্রভাব: প্রত্যক্ষ কর অর্থনীতিতে একটি স্থিতিশীল আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। এটি সরকারি রাজস্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে সাহায্য করে। পরোক্ষ কর প্রায়শই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, যা মুদ্রাস্ফীতিকে উৎসাহিত করতে পারে। তবে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উপর এর সরাসরি প্রভাব কম থাকে, কারণ এটি সরাসরি আয় বা পুঁজির উপর নির্ভর করে না।
৬। কর ফাঁকি: প্রত্যক্ষ কর ফাঁকি দেওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। কারণ এটি আয়ের উপর নির্ভর করে, এবং অনেক সময় আয়ের উৎস গোপন করা যায়। কর বিভাগের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও, কিছু মানুষ কর ফাঁকি দিতে সফল হয়। পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া কঠিন, কারণ এটি পণ্য বা সেবা কেনাবেচার সময়ই আদায় হয়ে যায়। প্রতিটি লেনদেনের সাথে কর যুক্ত থাকায় এটি ফাঁকি দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
৭। রাজস্বের স্থিতিশীলতা: প্রত্যক্ষ কর থেকে সরকারের আয় তুলনামূলকভাবে স্থির থাকে, কারণ এটি মানুষের নিয়মিত আয়ের উপর নির্ভর করে। অর্থনৈতিক মন্দার সময় এটি সামান্য কমতে পারে, কিন্তু এর স্থিতিশীলতা অনেক বেশি। পরোক্ষ করের আয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভরশীল। যদি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় এবং কেনাকাটা কমে যায়, তাহলে পরোক্ষ কর থেকে সরকারের আয়ও কমে যায়।
৮। জনগণের উপর প্রভাব: প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে, করদাতারা সরাসরি করের পরিমাণ জানতে পারে। তাদের আয়ের একটি অংশ সরকার নিয়ে নিচ্ছে—এটি তাদের কাছে পরিষ্কার। ফলে অনেক সময় করদাতার মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে, করের পরিমাণ পণ্যের দামের মধ্যে মিশে থাকে, যা সাধারণ মানুষের কাছে সহজে দৃশ্যমান হয় না। তাই এর প্রভাব ততটা সরাসরি অনুভূত হয় না।
উপসংহার: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর—এই দুটি কর ব্যবস্থা একে অপরের পরিপূরক। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য উভয় করেরই সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। প্রত্যক্ষ কর যেখানে আয়ের বৈষম্য হ্রাস করে একটি ন্যায্য সমাজ গঠনে সাহায্য করে, সেখানে পরোক্ষ কর দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করে, যা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। একটি কার্যকর কর ব্যবস্থা একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
১। প্রকৃতি
২। আদায় প্রক্রিয়া
৩। করের বোঝা
৪। সাম্য নীতি
৫। অর্থনৈতিক প্রভাব
৬। কর ফাঁকি
৭। রাজস্বের স্থিতিশীলতা
৮। জনগণের উপর প্রভাব
১৯২৪ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রথম আয়কর আইন (Income Tax Act) প্রণয়ন করা হয়, যা ছিল প্রত্যক্ষ করের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। অন্যদিকে, ভারতে জিএসটি (GST) চালু হয় ২০১৭ সালে, যা পরোক্ষ কর ব্যবস্থার এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন। ২০০৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, ভারতের মোট রাজস্বের প্রায় ৫৪% আসে পরোক্ষ কর থেকে, যা প্রমাণ করে যে পরোক্ষ কর রাজস্ব সংগ্রহের একটি প্রধান উৎস। এই দুটি কর ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার দেশের আর্থিক ভিতকে মজবুত করে।

