- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা:- বাংলাদেশ, প্রকৃতির লীলাভূমি, যেখানে সবুজ আর জলের মিতালি নিত্যদিনের ঘটনা। তবে এই সৌন্দর্য মাঝে মাঝেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করে, আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা আর ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ রূপে। ভৌগোলিক অবস্থান আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই দুর্যোগগুলো যেন এদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণের কারণ ও তার ভয়াবহ প্রভাব নিয়েই আজকের আলোচনা।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ও প্রভাব আলোচনা করা হলো:-
১.ভৌগোলিক অবস্থান ও নিম্নভূমি: বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দুর্যোগের অন্যতম প্রধান কারণ। দেশটি বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত এবং অসংখ্য নদ-নদী দ্বারা জালের মতো বিছানো। এর উল্লেখযোগ্য অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছে হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি এখানে বেশি। ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং পরবর্তী জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, যার মূল কারণ ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের নিচু ভূমি।
২.জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়ন: বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে স্পষ্ট। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে উপকূলীয় অঞ্চলকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি।
৩.নদ-নদীর প্রভাব ও বন্যা: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বর্ষাকালে হিমালয় পর্বতমালা থেকে নেমে আসা বিপুল পরিমাণ জল এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীতে জলস্ফীতি ঘটে। এর ফলে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। ২০২০ সালের বন্যায় দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানির নিচে ছিল, যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন করে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।
৪.ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ প্রায়শই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। এসব ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাস জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। ২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়গুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
৫.ভূমিকম্পের ঝুঁকি: বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। বিশেষ করে সিলেট, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাঝারি থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুসারে, বেঙ্গল বেসিনে বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট লাইন রয়েছে, যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। ১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প এই অঞ্চলের ভূমিকম্পের ইতিহাসের একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত।
৬.খরার প্রভাব: উত্তরাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে খরা একটি নিয়মিত ঘটনা। বৃষ্টিপাতের অভাব এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। ২০১৯ সালের খরায় দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছিল, যার প্রভাব কৃষি ও জনজীবনে ব্যাপক ছিল।
৭.ভূমিধস ও পাহাড়ধস: পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে প্রায়শই ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা এবং বনভূমি ধ্বংসের কারণে এই ঝুঁকি আরও বেড়েছে। ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটিতে ভয়াবহ ভূমিধসে প্রায় ১৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছিল।
৮.লবণাক্ততা বৃদ্ধি: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা ক্রমশ বাড়ছে। এর ফলে কৃষি জমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে এবং মিঠা পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি লবণাক্ততার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
৯.অপরিকল্পিত নগরায়ন: অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাভূমি ভরাটের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি আরও বাড়ছে। ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা দেখা যায়, যা নগরবাসীর জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে।
১০.বনভূমি ধ্বংস: বনভূমি প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা স্তর হিসেবে কাজ করে। কিন্তু নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংসের ফলে ভূমিধস, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বনভূমি হ্রাস পেয়েছে।
১১.জনসংখ্যা ঘনত্ব: বাংলাদেশের উচ্চ জনসংখ্যা ঘনত্ব দুর্যোগের প্রভাবকে আরও প্রকট করে তোলে। সীমিত সম্পদ এবং ঘনবসতির কারণে দুর্যোগের সময় বিপুল সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া এবং ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
১২.সচেতনতার অভাব: অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত সচেতনতা ও প্রস্তুতি না থাকার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। দুর্যোগের পূর্বাভাস এবং করণীয় সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
১৩.দুর্বল অবকাঠামো: বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো দুর্যোগে সহজে ভেঙে পড়ে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো এবং উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
১৪.ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম: দুর্যোগের পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম অনেক সময় পর্যাপ্ত ও সময়োপযোগী না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ দীর্ঘমেয়াদী দুর্ভোগে পড়ে। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম এবং পুনর্বাসনের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
১৫.স্বাস্থ্য ঝুঁকি: প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর বিশুদ্ধ পানির অভাব, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং রোগ জীবাণুর বিস্তার বেড়ে যাওয়ায় ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো পানিবাহিত রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
১৬.জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বনাঞ্চল ও জলাভূমির ব্যাপক ক্ষতি হয়, যার ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে। অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী তাদের আবাসস্থল হারায় এবং বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে।
১৭.অর্থনৈতিক প্রভাব: প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। কৃষি, মৎস্য, শিল্প ও পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাস্তাঘাট, সেতু ও অন্যান্য অবকাঠামো ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হয় এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে।
১৮.সামাজিক প্রভাব: দুর্যোগের ফলে মানুষ বাস্তুহারা হয়, পরিবার বিচ্ছিন্ন হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা vulnerability-এর শিকার হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী মানসিক trauma-য় ভুগতে পারে।
১৯.খাদ্য নিরাপত্তা: বন্যা ও খরায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। দরিদ্র মানুষেরা খাদ্য সংকটে আরও বেশি ভোগে এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পায়।
২০.শিক্ষার ক্ষতি: দুর্যোগের কারণে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
২১.আন্তর্জাতিক সাহায্য: প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রায়শই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্যের উপর নির্ভর করে। তবে সময়মতো এবং পর্যাপ্ত সাহায্য না পেলে দুর্যোগের প্রভাব মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
উপসংহার:- বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ও প্রভাব বহুমাত্রিক এবং একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট কারণগুলো এই দুর্যোগের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে তোলে। দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ, সচেতনতা বৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। প্রকৃতির রুদ্রমূর্তির হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের পরিবেশের প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে এবং দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
একনজরে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলি: ভৌগোলিক অবস্থান ও নিম্নভূমি, জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়ন, নদ-নদীর প্রভাব ও বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্পের ঝুঁকি, খরার প্রভাব, ভূমিধস ও পাহাড়ধস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনভূমি ধ্বংস, জনসংখ্যা ঘনত্ব, সচেতনতার অভাব, দুর্বল অবকাঠামো, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, অর্থনৈতিক প্রভাব, সামাজিক প্রভাব, খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষার ক্ষতি, আন্তর্জাতিক সাহায্য।
বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি হয় ১.৫ লক্ষেরও বেশি। ২০০৭ সালের সিডরে ক্ষয়ক্ষতি হয় ১.৭ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৩ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হবে। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাফল্য অর্জন করলেও, ২০২৩ সালের বন্যায় ২৫ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

