- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: বাংলাদেশ, প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি, যার ভৌগোলিক অবস্থান একে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র পরিচিতি। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের এই দেশটি নদ-নদী, পাহাড়, সমতল ভূমি আর বিস্তৃত উপকূলের এক মনোমুগ্ধকর সমন্বয়। এর ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য শুধু এর প্রাকৃতিক পরিবেশকেই নয়, দেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। একটি কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে এর উর্বর মাটি আর জলবায়ু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা বাংলাদেশকে বৈচিত্র্যময় এক ভূখণ্ডে পরিণত করেছে।
১।অবস্থান ও সীমানা: বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার ক্রান্তীয় অঞ্চলে। দেশটির অধিকাংশ স্থান 20∘ উত্তর অক্ষাংশ থেকে 26∘ উত্তর অক্ষাংশের এবং 88∘ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে 92∘ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। এটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভারত দ্বারা বেষ্টিত, কেবল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে মিয়ানমার এবং দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এই সীমানা দেশের জলবায়ু, বাণিজ্য এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর মোট আয়তন প্রায় ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার, যা বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপগুলির অন্যতম।
২।নদ-নদীর জাল: বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়, কারণ এর বুক চিরে বয়ে গেছে অসংখ্য নদ-নদী। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র এবং সুরমার মতো বৃহৎ নদীগুলো এদেশের জীবনরেখা। এই নদীগুলো শুধু পানীয় জলের উৎস নয়, বরং দেশের যোগাযোগ, সেচ এবং মৎস্য সম্পদের ভিত্তি। এগুলোর পলি দ্বারা সৃষ্ট উর্বর ভূমি দেশের কৃষির জন্য অপরিহার্য। বর্ষাকালে নদীগুলির প্লাবন কখনও কখনও মারাত্মক হলেও, এটি মাটিকে নতুন করে উর্বরতা দেয়।
৩।ব-দ্বীপ ও সমভূমি: বাংলাদেশ হলো পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ, যা মূলত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী ব্যবস্থার পলি সঞ্চয়ের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ ভূমিই সমতল এবং উর্বর পলিমাটি দিয়ে গঠিত। এই বিস্তীর্ণ সমভূমি ধান, পাট, চা এবং অন্যান্য ফসলের চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এই সমতল ভূমি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারে সুবিধা দিলেও, এর নিচু হওয়ার কারণে এটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
৪।জলবায়ু ও প্রকৃতি: বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি প্রকৃতির। এখানে সাধারণত ছয়টি ঋতুর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হলেও, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত—এই তিনটি ঋতু প্রধান। গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও আর্দ্র, বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, আর শীতকাল তুলনামূলকভাবে মৃদু ও শুষ্ক। মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ এই জলবায়ুকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এই জলবায়ু দেশের জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং এটি ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।
৫।পাহাড় ও মালভূমি: দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, যা পাহাড় ও মালভূমিতে আবৃত। এই অঞ্চলের প্রধান পর্বতমালাগুলো হলো লুসাই পাহাড়ের অংশবিশেষ এবং আরাকান যোমা পর্বতমালার শেষভাগ। এখানে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ—তাজিংডং (বিজয়), যার উচ্চতা প্রায় ১,২৮০ মিটার। এই পাহাড়ি অঞ্চল দেশের বাকি সমতল ভূমি থেকে ভিন্ন এক প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য বহন করে, যা পর্যটন ও বনায়নকে উৎসাহিত করে।
৬।উপকূল ও সমুদ্র: দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থাকায় বাংলাদেশের একটি দীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে, যা প্রায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই উপকূলীয় অঞ্চলে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন—সুন্দরবন, যা দেশের প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। এই উপকূল অঞ্চল সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ এবং লোনাপানির জলজ জীবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং সামুদ্রিক ক্ষয়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
৭।প্রাকৃতিক সম্পদ: বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ, যা দেশের প্রধান খনিজ সম্পদ। এছাড়াও, এখানে কয়লা, চুনাপাথর এবং সিলিকা বালির মতো খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়। দেশের উর্বর মাটি এবং নদ-নদীর কারণে কৃষি সম্পদ (যেমন: ধান, পাট, চা) এবং মৎস্য সম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবনের মতো বনভূমি মূল্যবান কাঠ এবং বিভিন্ন ধরনের বনজ সম্পদ সরবরাহ করে।
৮।উর্বর পলিমাটি: দেশের অধিকাংশ ভূমিই গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার বাহিত পলি দ্বারা গঠিত, যা মাটিকে অত্যন্ত উর্বর করে তুলেছে। এই উর্বরতা বাংলাদেশের কৃষির মেরুদণ্ড। এই মাটির গভীরতা এবং পুষ্টিগুণ বিভিন্ন প্রকার ফসল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। বছরের পর বছর ধরে নদীর প্লাবনের কারণে এই উর্বরতা বজায় থাকে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
৯।জীববৈচিত্র্যের আধার: নদ-নদী, ব-দ্বীপ, সমভূমি, পাহাড় এবং উপকূলের বৈচিত্র্যের কারণে বাংলাদেশে এক বিশাল জীববৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। সুন্দরবনে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, যা একটি বিশ্বখ্যাত প্রজাতি। এই দেশে রয়েছে বিপুল সংখ্যক উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতি। এই প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করা দেশের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
উপসংহার: বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য একে বিশ্ব মানচিত্রে এক বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। উর্বর সমভূমি, নদ-নদীর প্রাচুর্য এবং ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু এটিকে করেছে কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ আধার। একই সাথে, এর অবস্থান এবং ব-দ্বীপীয় প্রকৃতি একে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতেও ফেলেছে। এই অনন্য ভৌগোলিক চরিত্রই বাংলাদেশের সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনধারাকে রূপ দিয়েছে।
- 🌍 অবস্থান ও সীমানা
- 💧 নদ-নদীর জাল
- 🏝️ ব-দ্বীপ ও সমভূমি
- ☀️ জলবায়ু ও প্রকৃতি
- ⛰️ পাহাড় ও মালভূমি
- 🌊 উপকূল ও সমুদ্র
- 🛢️ প্রাকৃতিক সম্পদ
- 🌱 উর্বর পলিমাটি
- 🐅 জীববৈচিত্র্যের আধার
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ভোলার ঘূর্ণিঝড় ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভঙ্গুরতা প্রমাণ করে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ও একই রকম বিধ্বংসী ছিল। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীপ্রণালী বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জলপ্রবাহ ব্যবস্থা। ২০০৭ সালে সুন্দরবনকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। দেশের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধে ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সাথে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে জয়লাভ বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে বাড়িয়েছে।

