- readaim.com
- 0

উত্তর::উপস্থাপনা:- আমাদের এই গ্রহ নানা জাতি, রাষ্ট্র আর সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ। প্রতিদিন আমরা একে অপরের সাথে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হচ্ছি – ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি কিংবা প্রযুক্তির হাত ধরে। এই যে আন্তঃসংযোগ আর নির্ভরশীলতার জাল, যা গোটা বিশ্বকে এক সূত্রে বেঁধেছে, তাকেই সাধারণভাবে ‘বিশ্ব ব্যবস্থা’ বলা যেতে পারে। আসুন, সহজ ভাষায় এই ধারণাটি আরও একটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
সহজভাবে বলতে গেলে, বিশ্ব ব্যবস্থা হলো এমন একটি ধারণা যা আমাদের বিশ্বকে একটি একক এবং জটিল সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখে। এখানে বিভিন্ন দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বহুজাতিক কোম্পানি এবং ব্যক্তি একে অপরের সাথে ক্ষমতা, সম্পদ এবং তথ্যের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত। এই সম্পর্ক কখনো সহযোগিতার, আবার কখনো প্রতিযোগিতার হতে পারে। বিশ্ব ব্যবস্থা কোনো স্থির বিষয় নয়, বরং এটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভরশীল।
সাধারণভাবে আমরা যখন বিশ্ব ব্যবস্থার কথা ভাবি, তখন হয়তো বিভিন্ন দেশের মধ্যেকার রাজনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন অথবা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা যেমন – জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ কিংবা মহামারীর কথাই মনে আসে। আমরা হয়তো দেখি কিভাবে একটি দেশের ঘটনা অন্য দেশকে প্রভাবিত করে, অথবা কিভাবে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন বিভিন্ন রাষ্ট্রের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ভাবনাগুলো বিশ্ব ব্যবস্থার একটি অংশকে তুলে ধরে।
বিশ্ব ব্যবস্থার ধারণাটিকে বিভিন্ন বিজ্ঞানী, মনীষী ও গবেষক বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিচে তাঁদের কয়েকজনের উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা ইংরেজি নামসহ উল্লেখ করা হলো:-
১.ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন: “বিশ্ব ব্যবস্থা হলো একটি ঐতিহাসিক সামাজিক ব্যবস্থা, যেখানে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও অঞ্চল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পরস্পর নির্ভরশীল।” (“The modern world-system is a historical social system in which states and regions are economically and politically interdependent.”)
২.জন মেয়ার: “বিশ্ব ব্যবস্থা হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি কাঠামো, যেখানে শক্তি ও সম্পদের বণ্টন নির্ধারিত হয়।”
(“The world system is a framework of international relations where power and resources are distributed.”)
৩.ফার্নান্দ ব্রোডেল: “এটি দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, যা বিশ্বকে একসূত্রে বাঁধে।”
(“It is a long-term economic and cultural process that binds the world together.”)
৪.নোয়াম চমস্কি: “বিশ্ব ব্যবস্থা হলো কর্পোরেশন ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি কাঠামো।” (“The world system is a structure controlled by corporations and powerful states.”)
৫.অ্যান্থনি গিডেন্স: “এটি আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সংযোগের সমষ্টি।”
(“It is the sum of political, economic, and technological interconnections in the modern world.”)
৬.স্যামুয়েল হান্টিংটন: “বিশ্ব ব্যবস্থা হলো সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংঘাত ও সহাবস্থানের ফলাফল।” (“The world system is the outcome of conflict and coexistence among civilizations.”)
উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে আমরা বলতে পারি— বিশ্ব ব্যবস্থা হলো একটি জটিল ও গতিশীল কাঠামো, যেখানে দেশ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত এবং এটি সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়।
বিশ্ব ব্যবস্থার আলোচনায় বেশ কয়েকজন চিন্তাবিদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যাঁদের মধ্যে সামির আমিন এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তৃতীয় বিশ্বের এই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী বিশ্ব পুঁজিবাদের স্বরূপ উন্মোচন এবং প্রান্তিক দেশগুলোর উন্নয়নের পথে বিদ্যমান বাধাগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তাঁর তত্ত্ব শুধু একাডেমিক মহলেই নয়, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর নীতি নির্ধারণেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। আসুন, সহজ ভাষায় সামির আমিনের বিশ্ব ব্যবস্থা তত্ত্বের মূল দিকগুলো আলোচনা করা যাক।
১.অসম উন্নয়ন ও কেন্দ্রের আধিপত্য: সামির আমিন তাঁর তত্ত্বের একেবারে শুরুতেই বিশ্ব পুঁজিবাদের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন – অসম উন্নয়ন। তাঁর মতে, বিশ্ব ব্যবস্থা মূলত একটি কেন্দ্র (core) এবং প্রান্তের (periphery) মধ্যেকার অসম সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। কেন্দ্র হলো উন্নত, শিল্পোন্নত দেশগুলো, যারা প্রযুক্তি, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে। অন্যদিকে, প্রান্ত হলো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশগুলো, যারা মূলত কেন্দ্রকে কাঁচামাল সরবরাহ করে এবং সস্তা শ্রমের উৎস হিসেবে কাজ করে। এই অসম সম্পর্কের কারণে প্রান্তিক দেশগুলো কখনোই কেন্দ্রের সমকক্ষ হতে পারে না।
২.প্রান্তের নির্ভরশীলতা: আমিন জোর দিয়ে বলেন যে, প্রান্তিক দেশগুলোর অর্থনীতি কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা বিভিন্নভাবে তৈরি হয় – বাণিজ্যের শর্ত, ঋণের বোঝা, প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ। প্রান্তিক দেশগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না এবং কেন্দ্রের তৈরি করা অর্থনৈতিক কাঠামোর অধীনে থাকতে বাধ্য হয়। এই নির্ভরশীলতার কারণে প্রান্তের দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক নীতি স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করতে পারে না।
৩.পুঁজি সঞ্চয়নের বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া: আমিন মনে করেন যে, পুঁজি সঞ্চয়নের প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এবং এটি কেন্দ্র থেকে প্রান্তের দিকে প্রবাহিত হয় না, বরং প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হয়। প্রান্তিক দেশগুলো থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য বিভিন্ন মাধ্যমে কেন্দ্রে চলে যায়, যা কেন্দ্রের আরও দ্রুত উন্নয়নে সাহায্য করে এবং প্রান্তকে আরও পিছিয়ে রাখে। এই অবিরাম প্রক্রিয়া অসম উন্নয়নকে আরও গভীর করে তোলে।
৪.ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: আমিন তাঁর তত্ত্বে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি দেখান কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে কেন্দ্র প্রান্তের ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং পরবর্তীতে নয়া-ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে সেই আধিপত্য বজায় রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল থেকে যায়।
৫.প্রান্তের কাঠামোগত দুর্বলতা: আমিন প্রান্তিক দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেন, যা তাদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্বল শিল্প ভিত্তি, কৃষির ওপর अत्यधिक নির্ভরতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং শিক্ষার অভাব। এই দুর্বলতাগুলো প্রান্তিক দেশগুলোকে বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে বাধা দেয়।
৬.বিশ্ববাজারের ভূমিকা: আমিন বিশ্ববাজারকে একটি নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে দেখেন না। তাঁর মতে, বিশ্ববাজার কেন্দ্রের স্বার্থে কাজ করে এবং প্রান্তিক দেশগুলোকে তাদের দুর্বল অবস্থানের কারণে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। বিশ্ববাজারের নিয়মকানুন এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে উন্নত দেশগুলো সুবিধা পায় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
৭.প্রযুক্তিগত বৈষম্য: প্রযুক্তিগত দিক থেকে কেন্দ্র এবং প্রান্তের মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান বিদ্যমান। উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়নে এগিয়ে থাকে, যার ফলে তারা উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, প্রান্তিক দেশগুলো প্রযুক্তির জন্য কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং প্রায়শই পুরনো ও অকার্যকর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এই প্রযুক্তিগত বৈষম্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।
৮.ঋণের ফাঁদ: আমিন মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক ঋণ প্রান্তিক দেশগুলোকে একটি স্থায়ী ঋণের ফাঁদে ফেলে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ প্রায়শই এমন শর্তের সাথে আসে যা প্রান্তিক দেশগুলোর অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তোলে। ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায়, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের সুযোগ কমিয়ে দেয়।
৯.বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব: বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমিন মনে করেন যে, এই কোম্পানিগুলো প্রায়শই প্রান্তিক দেশগুলোর সম্পদ শোষণ করে এবং তাদের স্থানীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। তারা মুনাফা কেন্দ্রে নিয়ে যায় এবং প্রান্তিক দেশগুলোতে তেমন কোনো দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না।
১০.রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: প্রান্তিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একটি সাধারণ ঘটনা। আমিন মনে করেন যে, বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্র এই অস্থিতিশীলতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। দুর্বল এবং ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলো কেন্দ্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য সহজ লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
১১.সাংস্কৃতিক আধিপত্য: অর্থনৈতিক আধিপত্যের পাশাপাশি কেন্দ্র প্রান্তের ওপর সাংস্কৃতিক আধিপত্যও বিস্তার করে। গণমাধ্যম, শিক্ষা এবং বিনোদনের মাধ্যমে কেন্দ্রের মূল্যবোধ, জীবনধারা এবং ভোগবাদী সংস্কৃতি প্রান্তিক দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, যা স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে দুর্বল করে তোলে।
১২. আঞ্চলিক অসমতা: আমিন শুধু কেন্দ্র ও প্রান্তের অসমতার কথাই বলেন না, বরং প্রান্তিক দেশগুলোর মধ্যেও আঞ্চলিক অসমতা বিদ্যমান বলে মনে করেন। কিছু অঞ্চল অন্যদের তুলনায় বেশি সুবিধা পায়, যা সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং অভ্যন্তরীণ বিভেদ তৈরি করে।
১৩.সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদ: আমিন সাম্রাজ্যবাদকে বিশ্ব পুঁজিবাদের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখেন। ঔপনিবেশিক যুগের প্রত্যক্ষ শাসনের পর নয়া সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে কেন্দ্র এখনও প্রান্তের ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং নীতি এই নয়া সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে সাহায্য করে।
১৪.জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের গুরুত্ব: আমিন প্রান্তিক দেশগুলোর জন্য জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ওপর জোর দেন। তাঁর মতে, সত্যিকারের উন্নয়ন এবং কেন্দ্রের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রান্তিক দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে এবং একটি বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
১৫.স্বনির্ভর উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা: আমিন প্রান্তিক দেশগুলোর জন্য স্বনির্ভর উন্নয়নের একটি মডেলের কথা বলেন। এর অর্থ হলো নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করা এবং কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। স্থানীয় সম্পদ ও জ্ঞানকে ব্যবহার করে একটি টেকসই উন্নয়ন কৌশল তৈরি করা প্রয়োজন।
১৬.বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন: আমিন মনে করতেন যে, বিশ্ব ব্যবস্থা স্থির নয় এবং এর পরিবর্তন সম্ভব। প্রান্তিক দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং কেন্দ্রের অভ্যন্তরে থাকা প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সমর্থন একটি নতুন, fairer বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে।
১৭.সমাজতান্ত্রিক বিকল্প: আমিন বিশ্ব পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলেন। তাঁর মতে, একটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা অসমতা এবং শোষণমুক্ত হতে পারে এবং প্রান্তিক দেশগুলোর সত্যিকারের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
১৮.১৯৮০-এর দশকের সংকট: ১৯৮০-এর দশকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা আমিন এর তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে দেখেন। এই সময় উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে এবং তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
১৯.বিশ্বায়ন ও এর প্রভাব: যদিও বিশ্বায়ন বিশ্বকে আরও সংযুক্ত করেছে, আমিন মনে করেন যে, বর্তমানের বিশ্বায়ন মূলত কেন্দ্রের স্বার্থেই কাজ করছে এবং প্রান্তিক দেশগুলোকে আরও প্রান্তিক করে তুলছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং অবাধ বাণিজ্যের নীতি উন্নত দেশগুলোকে আরও সুবিধা দিচ্ছে।
২০.কোভিড-১৯ মহামারী: সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্ব ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং অসমতাকে আরও প্রকটভাবে সামনে এনেছে। টিকার অসম বণ্টন এবং অর্থনৈতিক ধাক্কা প্রান্তিক দেশগুলোকে আরও কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা আমিনের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করে।
২১.ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: আমিন আশাবাদী ছিলেন যে, প্রান্তিক দেশগুলো সম্মিলিতভাবে একটি বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে, যেখানে ন্যায্যতা, সমতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা প্রধান ভিত্তি হবে। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সচেতনতা, ঐক্য এবং একটি সুচিন্তিত উন্নয়ন কৌশল।
পরিসমাপ্তি:- সামির আমিনের বিশ্ব ব্যবস্থা তত্ত্ব বিশ্ব পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত অসমতা এবং প্রান্তিক দেশগুলোর চিরস্থায়ী পশ্চাৎপদতার একটি গভীর বিশ্লেষণ প্রদান করে। তাঁর ধারণা শুধু একাডেমিক আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুক্তি ও স্বনির্ভরতার সংগ্রামে এক নতুন দিশা দেখিয়েছে। আজও তাঁর তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিতর্কে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং প্রভাবশালী।
অসম উন্নয়ন ও কেন্দ্রের আধিপত্য, প্রান্তের নির্ভরশীলতা, পুঁজি সঞ্চয়নের বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, প্রান্তের কাঠামোগত দুর্বলতা, বিশ্ববাজারের ভূমিকা, প্রযুক্তিগত বৈষম্য, ঋণের ফাঁদ, বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, আঞ্চলিক অসমতা, সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের গুরুত্ব, স্বনির্ভর উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা, বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন, সমাজতান্ত্রিক বিকল্প, ১৯৮০-এর দশকের সংকট, বিশ্বায়ন ও এর প্রভাব, কোভিড-১৯ মহামারী, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
- ১৯৭৪ সালে সামির আমিন তার বিখ্যাত বই “Accumulation on a World Scale” প্রকাশ করেন, যা বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্বের মাইলফলক হয়ে ওঠে।
- ১৯৮০-২০০০ সময়ে IMF-এর কাঠামোগত সমন্বয় নীতির কারণে আফ্রিকার ৩৫টি দেশে দারিদ্র্য বেড়ে যায়।
- ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে G20 দেশগুলো ১০ ট্রিলিয়ন ডলার বাঁচাতে পেরেছিল, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো চরম ক্ষতির শিকার হয়।
- ২০২৩ সালের Oxfam রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ১% ধনী মানুষের সম্পদ বাকি ৯৯% মানুষের সমান।
- ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রান্তের দেশগুলোতে ২০০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়।