- readaim.com
- 0

ভূমিকা:- ইতিহাসের গতিপথ নিয়ে চিন্তা করতে গেলে অসওয়াল্ড স্পেংলারের নাম অবশ্যই আসে। তিনি জার্মান দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ ছিলেন, যিনি তার বিখ্যাত বই “The Decline of the West” (১৯১৮) এ মানব সভ্যতার চক্রাকার উত্থান-পতনের তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তার মতে, প্রতিটি সভ্যতা জীবন্ত প্রাণীর মতো জন্ম নেয়, বিকশিত হয় এবং অবশেষে মৃত্যুবরণ করে। আজ আমরা এই তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো সহজ ভাষায় আলোচনা করব।
১.স্পেংলারের মূল ধারণা:- স্পেংলার বিশ্বাস করতেন যে সভ্যতাগুলো জৈবিক প্রাণীর মতোই একটি নির্দিষ্ট জীবনচক্র অনুসরণ করে। প্রতিটি সভ্যতার চারটি প্রধান পর্যায় থাকে: জন্ম, বিকাশ, পরিপক্কতা এবং পতন। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতাকে তার শেষ পর্যায়ে দেখেছিলেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এটি ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। তার মতে, ইতিহাস রৈখিক নয়, বরং চক্রাকার।
২. সভ্যতার সংস্কৃতি ও সভ্যতা:- স্পেংলার স্পষ্টভাবে সংস্কৃতি (Culture) এবং সভ্যতা (Civilization) এর মধ্যে পার্থক্য করেন। সংস্কৃতি হলো সৃষ্টিশীল ও গতিশীল পর্যায়, যেখানে শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মের বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে, সভ্যতা হল সংস্কৃতির শেষ পর্যায়, যেখানে যান্ত্রিকতা, বাণিজ্য ও রাজনৈতিক প্রাধান্য দেখা দেয়। পাশ্চাত্য সভ্যতা তার মতে এই শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
৩.আটটি প্রধান সভ্যতা:- স্পেংলার আটটি প্রধান সভ্যতার কথা উল্লেখ করেছেন: মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, ভারতীয়, চীনা, গ্রিক-রোমান (Apollonian), আরবীয় (Magian), মেক্সিকান ও পাশ্চাত্য (Faustian)। তার মতে, প্রতিটি সভ্যতার নিজস্ব ‘আত্মা’ বা মূল চেতনা আছে, যা তার বিকাশকে নির্দেশ করে। পাশ্চাত্য সভ্যতার আত্মা হল ‘ফস্টিয়ান’, যা অসীমের জন্য লালসা প্রকাশ করে।
৪.সভ্যতার পতনের লক্ষণ:- স্পেংলার সভ্যতার পতনের কিছু স্পষ্ট লক্ষণ চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট, যুদ্ধ, শিল্প-সাহিত্যের অবনতি, নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। তিনি মনে করতেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা ২০শ শতাব্দীতে এই লক্ষণগুলো প্রকাশ করছে এবং ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগোচ্ছে।
৫.গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের ভূমিকা:- স্পেংলার গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদকে সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখেন। তার মতে, এই ব্যবস্থাগুলো মানুষের মধ্যে ভোগবাদ ও ব্যক্তিস্বার্থকে উৎসাহিত করে, যা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ডেকে আনে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পুঁজিবাদী সমাজ একসময় অভ্যন্তরীণ সংঘাতের মাধ্যমে ধ্বংস হবে।
৬.যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যের পতন:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় স্পেংলার তার বই লেখেন, যেখানে তিনি যুদ্ধকে সভ্যতার পতনের একটি স্বাভাবিক পর্যায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, সাম্রাজ্যগুলো যখন সর্বোচ্চ সম্প্রসারণে পৌঁছায়, তখন অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বাহ্যিক আক্রমণে তাদের পতন অনিবার্য। রোমান সাম্রাজ্যের পতন তার তত্ত্বের একটি উদাহরণ।
৭.ধর্মের ভূমিকা:- স্পেংলার ধর্মকে সভ্যতার প্রাথমিক স্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করতেন। কিন্তু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে ধর্মের প্রভাব কমে যায় এবং বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ তার স্থান নেয়। তিনি মনে করতেন, পাশ্চাত্য সভ্যতায় ধর্মের প্রভাব হ্রাস পাওয়াও পতনের একটি লক্ষণ।
৮.অন্যান্য দার্শনিকদের সাথে তুলনা:- স্পেংলারের তত্ত্ব কার্ল মার্ক্স বা হেগেলের রৈখিক ইতিহাসবাদের বিপরীত। মার্ক্স মনে করতেন সমাজ একটি নির্দিষ্ট গতিতে উন্নতির দিকে এগোয়, কিন্তু স্পেংলার বলেছেন সভ্যতাগুলো চক্রাকারে আবর্তিত হয়। তার তত্ত্ব আরনল্ড টয়নবির সভ্যতা তত্ত্বকেও প্রভাবিত করেছে।
৯.সমালোচনা ও গ্রহণযোগ্যতা:- অনেক ইতিহাসবিদ স্পেংলারের তত্ত্বকে অত্যধিক নিয়তিবাদী ও দার্শনিক বলে সমালোচনা করেছেন। তারা বলেন, তার তত্ত্বে ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব আছে। তবে, ২০শ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো অনেককে তার ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে।
১০.বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা:- আজকের বিশ্বে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, পরিবেশগত সংকট ও সাংস্কৃতিক সংঘাত দেখে অনেকেই স্পেংলারের তত্ত্ব নতুন করে ভাবছেন। তার ধারণা আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক করে। পাশ্চাত্য সভ্যতা কি সত্যিই পতনের দিকে? নাকি এটি নতুনভাবে নিজেকে পুনর্গঠন করবে?
উপসংহার:- অসওয়াল্ড স্পেংলারের তত্ত্ব মানব সভ্যতাকে একটি প্রাণবন্ত সত্তা হিসেবে দেখে, যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি চক্র অনুসরণ করে। তার বিশ্লেষণ ইতিহাসের গতিপথ বুঝতে সাহায্য করে, যদিও তা বিতর্কিত। আজকের বিশ্বে তার চিন্তাধারা নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে। সভ্যতার স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন হতে অনুপ্রাণিত করেন।
১.স্পেংলারের মূল ধারণা
২.সভ্যতার সংস্কৃতি ও সভ্যতা
৩.আটটি প্রধান সভ্যতা
৪.সভ্যতার পতনের লক্ষণ
৫.গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের ভূমিকা
৬.যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যের পতন
৭.ধর্মের ভূমিকা
৮.অন্যান্য দার্শনিকদের সাথে তুলনা
৯.সমালোচনা ও গ্রহণযোগ্যতা
১০.বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা
স্পেংলারের “The Decline of the West” বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পাশ্চাত্য সভ্যতা ২০০০ সালের পর পতনের দিকে যাবে। তার তত্ত্ব নাত্সি জার্মানিকে প্রভাবিত করেছিল, যদিও স্পেংলার নিজে হিটলারকে সমর্থন করেননি। ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়নবি স্পেংলারের চক্রাকার তত্ত্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সমীক্ষা অনুযায়ী, ৬৫% ইতিহাসবিদ মনে করেন সভ্যতার পতন একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া, যা স্পেংলারের তত্ত্বের সাথে মিলে যায়।