- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা:- মানব সমাজ এক দীর্ঘ এবং জটিল বিবর্তনের ফসল। সময়ের স্রোতে, পরিবেশের পরিবর্তনে, এবং মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় ভর করে সমাজ বিভিন্ন স্তরে বিকশিত হয়েছে। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের যাযাবর জীবন থেকে শুরু করে আজকের জটিল জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, এই পথ ছিল বন্ধুর এবং পরিবর্তনশীল। আসুন, মানব সমাজের বিকাশের সেই গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলোর দিকে আমরা আলোকপাত করি।
১. শিকার ও খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজ (প্রায় ৩০ লক্ষ বছর পূর্ব পর্যন্ত): মানব সমাজের একদম প্রাথমিক স্তর ছিল এটি। ছোট ছোট দলবদ্ধ মানুষ ফলমূল সংগ্রহ করে, শিকার করে এবং যাযাবরের মতো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াত। তাদের জীবনযাত্রা প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। পাথরের তৈরি সরল হাতিয়ার ব্যবহার করত তারা। প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে আগুনের ব্যবহার আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে তাদের জীবনযাত্রায় বড় পরিবর্তন আসে।
২. উদ্যানকৃষিভিত্তিক সমাজ (প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্ব): কৃষিকাজের প্রাথমিক রূপ হিসেবে উদ্যানচর্চার শুরু হয় এই সময়ে। মানুষ ছোট আকারে জমি তৈরি করে খাদ্য উৎপাদন করতে শেখে। এর ফলে যাযাবর জীবনের কিছুটা অবসান হয় এবং ছোট ছোট বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। নারীরা এই সময়ে খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এর বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।
৩. কৃষিনির্ভর সমাজ (প্রায় ৫,০০০ বছর পূর্ব): লাঙলের ব্যবহার এবং পশুশক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং শ্রম বিভাজন দেখা দেয়। স্থায়ী বসতি স্থাপন এবং গ্রামভিত্তিক সমাজের উদ্ভব হয়। সম্পত্তির ধারণা এবং সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রাথমিক রূপ এই সময়েই লক্ষ করা যায়। মেসোপটেমিয়া এবং নীলনদ উপত্যকায় এই ধরনের সমাজের বিকাশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৪. পশুপালন সমাজ (বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়): কিছু অঞ্চলে, বিশেষত যেখানে কৃষিকাজ কঠিন ছিল, মানুষ পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। তারা বিভিন্ন পশুকে domestication করে খাদ্য, বস্ত্র এবং পরিবহনের জন্য ব্যবহার করত। যাযাবর বা আধা-যাযাবর জীবনযাপন এই সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু যাযাবর গোষ্ঠী আজও এই ধরনের জীবনযাপন করে।
৫. সামন্তবাদী সমাজ (মধ্যযুগ): কৃষিনির্ভর সমাজের পরবর্তী ধাপে জমির মালিকানা এবং বংশানুক্রমিক শাসনের ভিত্তিতে এই সমাজের উদ্ভব হয়। রাজা বা অভিজাত শ্রেণির হাতে জমির নিয়ন্ত্রণ থাকত এবং কৃষকরা তাদের অধীনে কাজ করত। সামাজিক স্তরবিন্যাস ছিল অত্যন্ত কঠোর। ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন অংশে এই সমাজ দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান ছিল।
৬. শিল্পভিত্তিক সমাজ (আঠারো শতক থেকে): শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে এই সমাজের সূচনা হয়। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন এবং নতুন নতুন যন্ত্রপাতির আবিষ্কার উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। গ্রাম থেকে শহরের দিকে মানুষেরmigration বাড়ে এবং কারখানাভিত্তিক উৎপাদন প্রধান হয়ে ওঠে। নতুন সামাজিক শ্রেণি – শ্রমিক ও পুঁজিপতির উদ্ভব হয়। ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে এই বিপ্লবের সূচনা হয়।
৭. তথ্যভিত্তিক সমাজ (বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে): কম্পিউটার, ইন্টারনেট এবং তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে এই সমাজের উদ্ভব হয়েছে। জ্ঞান এবং তথ্য এখানে প্রধান সম্পদ। উৎপাদন, অর্থনীতি এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নब्बे দশকের পর থেকে বিশ্বব্যাপী এই পরিবর্তন দ্রুত গতি লাভ করে।
৮. যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ (একবিংশ শতাব্দী): স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট যোগাযোগের পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিয়েছে। বিশ্ব এখন একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। তথ্য আদান-প্রদান এবং মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে।
৯. নগরায়ণ: মানব সমাজ বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নগরায়ণ। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পভিত্তিক সমাজে উত্তরণের সাথে সাথে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে মানুষের স্রোত বাড়ে। শহরগুলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ শহরে বাস করে (জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে)।
১০. জনসংখ্যার বৃদ্ধি: সময়ের সাথে সাথে মানবজাতির জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজে জনসংখ্যা ছিল খুবই কম। কৃষিকাজের উন্নতির সাথে সাথে জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং শিল্প বিপ্লবের পর তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটিরও বেশি।
১১. শ্রম বিভাজন ও বিশেষীকরণ: সমাজ বিকাশের সাথে সাথে শ্রম বিভাজন এবং বিশেষীকরণ বৃদ্ধি পায়। কৃষিভিত্তিক সমাজে যেখানে বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজের সাথে যুক্ত ছিল, শিল্পভিত্তিক এবং তথ্যভিত্তিক সমাজে বিভিন্ন ধরনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষ তাদের দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছে।
১২. সামাজিক স্তরবিন্যাস: বিভিন্ন স্তরের সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাস বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান ছিল। সামন্তবাদী সমাজে কঠোর শ্রেণিভেদ ছিল, যেখানে শিল্পভিত্তিক সমাজে কিছুটা সামাজিক গতিশীলতা দেখা যায়। তবে, আজও বিভিন্ন সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান।
১৩. পরিবারের বিবর্তন: মানব সমাজের বিকাশের সাথে সাথে পরিবারের কাঠামো এবং ভূমিকা পরিবর্তিত হয়েছে। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজে ছোট দলবদ্ধ পরিবার দেখা যেত। কৃষিভিত্তিক সমাজে যৌথ পরিবারের প্রাধান্য ছিল। শিল্পভিত্তিক সমাজে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
১৪. ধর্ম ও সংস্কৃতির বিকাশ: ধর্ম এবং সংস্কৃতি মানব সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন স্তরের সমাজে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপ বিকশিত হয়েছে।
১৫. রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্ভব: সমাজ যত জটিল হয়েছে, তত রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। গোত্রভিত্তিক সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা – রাজনৈতিক সংগঠনের বিবর্তন মানব সমাজের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
১৬. প্রযুক্তির প্রভাব: প্রতিটি স্তরের সমাজ বিকাশে প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পাথরের হাতিয়ার থেকে শুরু করে ইন্টারনেট – প্রযুক্তির উদ্ভাবন মানব জীবনযাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।
১৭. পরিবেশের উপর প্রভাব: মানব সমাজ বিকাশের সাথে সাথে প্রকৃতির উপর মানুষের প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজের প্রভাব কম থাকলেও, কৃষিকাজ এবং শিল্প বিপ্লবের পর পরিবেশের উপর মানুষের কার্যকলাপের সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়।
১৮. জ্ঞান ও শিক্ষার বিস্তার: তথ্যভিত্তিক সমাজে জ্ঞান এবং শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯. বৈশ্বিক যোগাযোগ ও আন্তঃনির্ভরশীলতা: বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ এবং আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত।
২০. মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পরিবর্তন: সময়ের সাথে সাথে সমাজের মূল্যবোধ ও নৈতিক ধারণার পরিবর্তন ঘটে।
২১. ভবিষ্যতের সমাজ: মানব সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জৈব প্রযুক্তি এবং মহাকাশ অনুসন্ধানের মতো নতুন প্রযুক্তি ভবিষ্যতের সমাজকে আরও নতুন দিকে ধাবিত করবে।
উপসংহার:- মানব সমাজের বিবর্তন একটি ধারাবাহিক ও গতিশীল প্রক্রিয়া, যেখানে প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নতুন নতুন স্তরের সৃষ্টি করেছে। প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক সমাজ থেকে আজকের জটিল ডিজিটাল সভ্যতা পর্যন্ত এই যাত্রায় মানবতা অভিযোজন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে টিকে থেকেছে। সমাজের এই পরিবর্তন শুধু বস্তুগত উন্নয়নই নয়, বরং চিন্তা, মূল্যবোধ ও সামষ্টিক সংগঠনেরও রূপান্তর। ভবিষ্যতে সমাজ আরও বহুমাত্রিক ও আন্তঃসংযুক্ত হবে, তবে তার ভিত্তি রচিত হয়েছে অতীতের স্তরগুলিরই উপর।
শিকার ও খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজ, উদ্যানকৃষিভিত্তিক সমাজ, কৃষিনির্ভর সমাজ, পশুপালন সমাজ, সামন্তবাদী সমাজ, শিল্পভিত্তিক সমাজ, তথ্যভিত্তিক সমাজ, যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ, নগরায়ণ, জনসংখ্যার বৃদ্ধি, শ্রম বিভাজন ও বিশেষীকরণ, সামাজিক স্তরবিন্যাস, পরিবারের বিবর্তন, ধর্ম ও সংস্কৃতির বিকাশ, রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্ভব, প্রযুক্তির প্রভাব, পরিবেশের উপর প্রভাব, জ্ঞান ও শিক্ষার বিস্তার, বৈশ্বিক যোগাযোগ ও আন্তঃনির্ভরশীলতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পরিবর্তন, ভবিষ্যতের সমাজ।
প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে কৃষিকাজের সূচনা মানব সমাজকে স্থায়ী বসতি স্থাপনে সাহায্য করে। আঠারো শতকের শিল্প বিপ্লব (১৭৬০-১৮৪০) ইংল্যান্ডে শুরু হয়ে পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইন্টারনেটের আবিষ্কার (১৯৮৩ সালে টিসিপি/আইপি প্রোটোকল প্রবর্তিত হয়) তথ্য আদান-প্রদানকে সহজ করে তোলে এবং তথ্যভিত্তিক সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে। বর্তমানে স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার (ফেসবুক ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করে) যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।