- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক মডেল, যেখানে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত উভয় খাতেরই সহাবস্থান দেখা যায়। এটি এমন এক পদ্ধতি যা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সেরা দিকগুলোকে একত্রিত করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো তৈরি করে। এই ব্যবস্থাটি একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, বরং সমাজের সকল স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও সহায়তা করে।
১। ব্যক্তিগত ও সরকারি খাতের সহাবস্থান: এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার পাশাপাশি সরকারি মালিকানাও বিদ্যমান। ব্যক্তিরা যেমন নিজেদের উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারে, তেমনি সরকারও দেশের গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল খাত যেমন প্রতিরক্ষা, রেলওয়ে, ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। এই দুই খাতের সমন্বয় একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগ উৎসাহিত হয় এবং একই সাথে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সেবাগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। ফলে, ব্যক্তিরা তাদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে পারে এবং সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে পারে।
২। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ: মিশ্র অর্থনীতিতে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকে। ব্যক্তিরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যবসা শুরু করতে পারে, বিনিয়োগ করতে পারে, এবং সম্পদ অর্জন করতে পারে। তবে এই স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়, বরং এটি সরকারের কিছু নিয়ম-কানুন ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পরিচালিত হয়। সরকার বাজার ব্যবস্থায় বিভিন্ন আইন ও নীতি প্রয়োগ করে যাতে কোনো ধরনের বৈষম্য বা শোষণের শিকার না হয়। যেমন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সুরক্ষা, এবং শ্রম আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাজারের সুস্থ প্রতিযোগিতা বজায় রাখে।
৩। পরিকল্পিত উন্নয়ন: মিশ্র অর্থনীতিতে সরকার দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পঞ্চবার্ষিক বা দশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন খাত যেমন শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে এবং সেই অনুযায়ী সম্পদ বরাদ্দ করে। এই পরিকল্পনাগুলো ব্যক্তিগত খাতের উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় করে সাজানো হয়, যাতে একটি দেশের সুষম এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে, দেশের অর্থনীতি কেবল ব্যক্তি-নির্ভর থাকে না, বরং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যায়।
৪। সামাজিক ন্যায়বিচার ও কল্যাণ: মিশ্র অর্থনীতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। সরকার শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেয় না, বরং সমাজের দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ, বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পেনশন, এবং বেকার ভাতা প্রদান করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য কমানো এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে কোনো মানুষই মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয় না।
৫। সম্পদের মিশ্র বণ্টন: এই ব্যবস্থায় সম্পদ বণ্টন শুধুমাত্র বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের উপর নির্ভর করে না। বাজার ব্যবস্থা ব্যক্তিগত সম্পদ সৃষ্টির সুযোগ দিলেও, সরকার কর ব্যবস্থা, ভর্তুকি, এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। ধনী ব্যক্তিদের উপর উচ্চ হারে কর আরোপ করা হয় এবং সেই অর্থ দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। এর ফলে, সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যেকার ব্যবধান কিছুটা কমে আসে এবং একটি স্থিতিশীল সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে।
৬। ভোক্তার সার্বভৌমত্ব: মিশ্র অর্থনীতিতে ভোক্তা বা ক্রেতার পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ভোক্তারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে পারে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী বাজারে নতুন নতুন পণ্য আসে। এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে সরকার জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা অবৈধ পণ্য থেকে ভোক্তাকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করে। এর মাধ্যমে ভোক্তারা একদিকে যেমন স্বাধীনতা উপভোগ করে, অন্যদিকে তেমনি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
৭। অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য: এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করে। কৃষি, শিল্প, এবং সেবা খাতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পগুলোও বিকাশ লাভ করে। সরকার সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে সহায়তা প্রদান করে, যার ফলে একটি দেশের অর্থনীতি শুধুমাত্র একটি খাতের উপর নির্ভরশীল না হয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়। এই বৈচিত্র্য অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমায় এবং দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৮। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা: মিশ্র অর্থনীতিতে মুক্ত বাজার ব্যবস্থার নীতি মেনে চলে, যা সুস্থ প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একই ধরনের পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ের মাধ্যমে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এই প্রতিযোগিতা পণ্যের মান উন্নত করে এবং দাম কমাতে সাহায্য করে, যা চূড়ান্তভাবে ভোক্তাদের জন্য লাভজনক হয়। তবে সরকার একচেটিয়া বাজার বা কার্টেল গঠন প্রতিরোধ করতে কঠোর আইন প্রয়োগ করে, যাতে কোনো একক কোম্পানি বাজারের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে।
উপসংহার: মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আধুনিক বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের জন্য একটি সফল মডেল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামাজিক ন্যায় ও কল্যাণের আদর্শের মধ্যে একটি সুন্দর সমন্বয় ঘটায়। এই ব্যবস্থা একদিকে যেমন ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে, তেমনি অন্যদিকে সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করে একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়তা করে। এটি একটি গতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক কাঠামো, যা পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম।
- ব্যক্তিগত ও সরকারি খাতের সহাবস্থান
- অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ
- পরিকল্পিত উন্নয়ন
- সামাজিক ন্যায়বিচার ও কল্যাণ
- সম্পদের মিশ্র বণ্টন
- ভোক্তার সার্বভৌমত্ব
- অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য
- সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা
১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার সময় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে মিশ্র অর্থনীতির ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করে। অনেক দেশ বুঝতে পারে যে শুধুমাত্র বাজারের উপর সবকিছু ছেড়ে দিলে সামাজিক বৈষম্য ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেতে পারে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস ১৯৩৬ সালে তার ‘দ্য জেনারেল থিওরি অফ এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট অ্যান্ড মানি’ গ্রন্থে বাজার অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, যা মিশ্র অর্থনীতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

