- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতিতে উপযোগ (utility) একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা কোনো পণ্য বা সেবা ভোগের মাধ্যমে একজন ভোক্তা যে তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি লাভ করে তা বোঝায়। এই উপযোগকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি: মোট উপযোগ ও প্রান্তিক উপযোগ। এই দুই ধরনের উপযোগের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান, যা ভোক্তার আচরণ এবং চাহিদার নিয়মাবলী বুঝতে সাহায্য করে। মোট উপযোগ হলো কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য ভোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত মোট তৃপ্তি, আর প্রান্তিক উপযোগ হলো অতিরিক্ত এক একক পণ্য ভোগের ফলে মোট উপযোগের যে পরিবর্তন হয়। এই নিবন্ধে আমরা এই দুটি ধারণার মধ্যেকার সম্পর্কটি সহজ ও আকর্ষণীয় ভাষায় ব্যাখ্যা করব।
১। মোট উপযোগ ও প্রান্তিক উপযোগের সংজ্ঞা: অর্থনীতিতে উপযোগ বলতে কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহার করে ভোক্তা যে তৃপ্তি পায়, তাকে বোঝায়। মোট উপযোগ (Total Utility) হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো পণ্য বা সেবার বিভিন্ন একক ভোগ করে একজন ভোক্তা যে মোট তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি একটি আপেল খান, তখন আপনি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তৃপ্তি পান। যদি আপনি দ্বিতীয় আপেলটি খান, তবে আপনার মোট তৃপ্তি বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, প্রান্তিক উপযোগ (Marginal Utility) হলো অতিরিক্ত এক একক পণ্য ভোগ করার ফলে মোট উপযোগের যে পরিবর্তন হয়, তা। অর্থাৎ, দ্বিতীয় আপেলটি খাওয়ার ফলে আপনার মোট তৃপ্তি যতটুকু বৃদ্ধি পেল, সেটিই হলো প্রান্তিক উপযোগ।
২। মোট উপযোগের বৃদ্ধি: মোট উপযোগ সাধারণত প্রান্তিক উপযোগের যোগফল। যখন একজন ভোক্তা কোনো পণ্য বা সেবা ভোগ করা শুরু করেন, তখন প্রত্যেক অতিরিক্ত একক ভোগের ফলে তার মোট উপযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বৃদ্ধি ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে যতক্ষণ না প্রান্তিক উপযোগ ধনাত্মক থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে, যতক্ষণ আপনি কোনো একটি জিনিস ব্যবহার করে তৃপ্তি পান, ততক্ষণ আপনার মোট তৃপ্তি বাড়তে থাকবে। তবে, এই বৃদ্ধি একই হারে হয় না। প্রথম একক ভোগে প্রাপ্ত তৃপ্তি সবচেয়ে বেশি থাকে এবং প্রতিটি অতিরিক্ত একক ভোগে এই তৃপ্তির পরিমাণ কমতে থাকে।
৩। প্রান্তিক উপযোগের হ্রাস: এটি প্রান্তিক উপযোগের একটি মৌলিক নিয়ম, যা অর্থনীতিতে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগের নিয়ম নামে পরিচিত। এই নিয়ম অনুযায়ী, কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একটি পণ্যের ভোগের পরিমাণ বাড়তে থাকলে, অতিরিক্ত একক থেকে প্রাপ্ত প্রান্তিক উপযোগ ক্রমশ কমতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি খুব তৃষ্ণার্ত থাকেন, তখন প্রথম গ্লাস পানি খেয়ে আপনি অনেক তৃপ্তি পান। দ্বিতীয় গ্লাস খেয়ে তৃপ্তি কিছুটা কমে যায়, এবং তৃতীয় গ্লাসে আরও কমে। এই ক্রমহ্রাসমান প্রবণতাই প্রান্তিক উপযোগের মূল বৈশিষ্ট্য।
৪। মোট উপযোগের সর্বোচ্চ বিন্দু: যখন প্রান্তিক উপযোগ শূন্য হয়ে যায়, তখন মোট উপযোগ তার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছায়। এই অবস্থায় ভোক্তা অতিরিক্ত কোনো একক পণ্য ভোগ করতে আর আগ্রহী থাকেন না, কারণ সেই একক থেকে তিনি কোনো অতিরিক্ত তৃপ্তি লাভ করেন না। যদি আপনি খুব তৃষ্ণার্ত থাকেন এবং পানি পান করতে থাকেন, একটা সময় আসবে যখন আপনার তৃষ্ণা পুরোপুরি মিটে যাবে। সেই অবস্থায় অতিরিক্ত এক গ্লাস পানি আপনার কাছে কোনো তৃপ্তি দেবে না, বরং সেটি অপ্রীতিকর মনে হতে পারে। এই বিন্দুতেই মোট উপযোগ সর্বোচ্চ হয় এবং প্রান্তিক উপযোগ শূন্য হয়ে যায়।
৫। প্রান্তিক উপযোগের শূন্য অবস্থা: যখন মোট উপযোগ সর্বোচ্চ হয়, তখন প্রান্তিক উপযোগ শূন্য হয়। এই অবস্থায় ভোক্তা আর কোনো অতিরিক্ত একক ভোগ করতে চায় না। কারণ এই অতিরিক্ত একক থেকে কোনো নতুন তৃপ্তি পাওয়া যায় না। বরং, তা মোট উপযোগের কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। এই অবস্থাটি হলো সেই ব্রেক-ইভেন পয়েন্ট, যেখানে ভোক্তা আর পণ্যটি ভোগ করে নতুন কোনো আনন্দ অনুভব করে না। এটি মোট উপযোগ ও প্রান্তিক উপযোগের মধ্যেকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, যা ভোক্তার সন্তুষ্টির চূড়ান্ত সীমা নির্দেশ করে।
৬। মোট উপযোগের হ্রাস: যখন প্রান্তিক উপযোগ ঋণাত্মক হয়ে যায়, তখন মোট উপযোগ হ্রাস পেতে শুরু করে। এটি ঘটে যখন একজন ভোক্তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য ভোগ করেন এবং সেই অতিরিক্ত ভোগ তার জন্য অসন্তোষজনক বা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। যেমন, অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে তা অস্বস্তির কারণ হতে পারে, যা মোট উপযোগকে কমিয়ে দেয়। এই পরিস্থিতিতে, ভোক্তা আর সেই পণ্যটি ভোগ করতে চায় না। এই পর্যায়টি ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগের নিয়মের চূড়ান্ত পর্যায়।
৭। দুই উপযোগের সম্পর্ক রেখাচিত্রের মাধ্যমে: একটি রেখাচিত্রে মোট উপযোগ এবং প্রান্তিক উপযোগের সম্পর্ক খুব সুন্দরভাবে দেখানো যায়। যখন প্রান্তিক উপযোগ রেখাটি ধনাত্মক থাকে, তখন মোট উপযোগ রেখাটি উর্ধ্বগামী হয়। যখন প্রান্তিক উপযোগ রেখাটি শূন্য হয়, তখন মোট উপযোগ রেখাটি তার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছায়। এবং যখন প্রান্তিক উপযোগ রেখাটি ঋণাত্মক হয়, তখন মোট উপযোগ রেখাটি নিম্নগামী হতে শুরু করে। এই রেখাচিত্রের সাহায্যে সম্পর্কটি সহজে অনুধাবন করা সম্ভব।
৮। মোট উপযোগ ও প্রান্তিক উপযোগের মধ্যে গাণিতিক সম্পর্ক: গাণিতিকভাবে, মোট উপযোগ (TU) হলো বিভিন্ন এককের প্রান্তিক উপযোগের (MU) সমষ্টি। অর্থাৎ, TUn=∑i=1nMUi। এর অর্থ হলো, প্রথম একক থেকে প্রাপ্ত উপযোগ, দ্বিতীয় একক থেকে প্রাপ্ত উপযোগ, এবং এভাবে সকল একক থেকে প্রাপ্ত উপযোগের সমষ্টিই হলো মোট উপযোগ। অন্যদিকে, প্রান্তিক উপযোগ হলো মোট উপযোগের পরিবর্তনের হার। অর্থাৎ, MUn=TUn−TUn−1। এই গাণিতিক সূত্র দুটি এই দুটি ধারণার সম্পর্ককে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
৯। চাহিদা রেখার সাথে সম্পর্ক: প্রান্তিক উপযোগের এই ধারণার সাথে চাহিদার নিয়মের একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু অতিরিক্ত একক ভোগের সাথে প্রান্তিক উপযোগ কমতে থাকে, তাই কোনো ভোক্তা একটি পণ্যের অতিরিক্ত একক ক্রয় করতে কেবল তখনই আগ্রহী হবেন যখন তার দাম কমে যাবে। এর ফলস্বরূপ, পণ্যের দাম কমলে তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এটিই চাহিদার নিয়মের মূল ভিত্তি। তাই, মোট ও প্রান্তিক উপযোগের সম্পর্ক ভোক্তার চাহিদার আচরণ বুঝতে সাহায্য করে।
উপসংহার: মোট উপযোগ এবং প্রান্তিক উপযোগের সম্পর্ক অর্থনীতির একটি মৌলিক বিষয়, যা ভোক্তার আচরণ এবং বাজারের গতিবিধি বুঝতে অত্যন্ত সহায়ক। যখন প্রান্তিক উপযোগ ধনাত্মক থাকে, তখন মোট উপযোগ বৃদ্ধি পায়। যখন প্রান্তিক উপযোগ শূন্য হয়, তখন মোট উপযোগ সর্বোচ্চ হয়। আর যখন প্রান্তিক উপযোগ ঋণাত্মক হয়, তখন মোট উপযোগ হ্রাস পেতে শুরু করে। এই সম্পর্কটিই ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগের নিয়মকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং দামের সাথে চাহিদার বিপরীত সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। তাই এই দুটি ধারণার গভীরতা উপলব্ধি করা অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য অপরিহার্য।
- ⭐মোট উপযোগ ও প্রান্তিক উপযোগের সংজ্ঞা
- ⭐মোট উপযোগের বৃদ্ধি
- ⭐প্রান্তিক উপযোগের হ্রাস
- ⭐মোট উপযোগের সর্বোচ্চ বিন্দু
- ⭐প্রান্তিক উপযোগের শূন্য অবস্থা
- ⭐মোট উপযোগের হ্রাস
- ⭐দুই উপযোগের সম্পর্ক রেখাচিত্রের মাধ্যমে
- ⭐মোট উপযোগ ও প্রান্তিক উপযোগের মধ্যে গাণিতিক সম্পর্ক
- ⭐চাহিদা রেখার সাথে সম্পর্ক
১৭০০-এর দশকের শেষ দিকে অর্থনীতিবিদরা উপযোগের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন, তবে ১৮০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভন্স, কার্ল মেংগার এবং লিওঁ ওয়ালরাসের মতো অর্থনীতিবিদরা প্রান্তিক উপযোগ তত্ত্বকে পূর্ণতা দেন। এই তত্ত্বটি ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির শ্রম মূল্য তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। ১৯৫০-এর দশকে স্যামুয়েলসন এবং হিকসের মতো অর্থনীতিবিদরা ভোক্তার আচরণ নিয়ে আরও গবেষণার মাধ্যমে উপযোগের এই ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ করেন।

