- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতির জটিল জগতে, রাজস্ব বাজেট এবং মূলধনী বাজেট দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা একটি দেশের আর্থিক কাঠামোকে ধারণ করে। এই দুটি ধারণা একে অপরের থেকে ভিন্ন হলেও, এদের সম্মিলিত কাজই একটি সরকারের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথ নির্ধারণ করে। সহজ কথায়, রাজস্ব বাজেট হলো সরকারের দৈনন্দিন খরচের হিসাব, আর মূলধনী বাজেট হলো দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য করা বিনিয়োগের খতিয়ান। এই দুই ধরনের বাজেটের মধ্যেকার পার্থক্য সঠিকভাবে বোঝা যেকোনো দেশের নাগরিকের জন্য জরুরি, কারণ এটি সরকারের আর্থিক সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে দেশের অগ্রগতিকে প্রভাবিত করে তা বুঝতে সাহায্য করে।
১. খরচের প্রকৃতি: রাজস্ব বাজেট মূলত সরকারের নিয়মিত এবং পুনরাবৃত্তিমূলক খরচগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, ভর্তুকি, বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম এবং ঋণের সুদ পরিশোধের মতো ব্যয়গুলো পড়ে। এই খরচগুলো সাধারণত কোনো সম্পদ তৈরি করে না বা উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে না, বরং দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং জনগণের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে সহায়ক। অন্যদিকে, মূলধনী বাজেট হলো সেই ব্যয়, যা দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ তৈরি করে। যেমন— রাস্তাঘাট, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল, এবং নতুন শিল্পকারখানা নির্মাণ। এই খরচগুলো দেশের অবকাঠামোকে উন্নত করে এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি স্থাপন করে।
২. অর্থের উৎস: রাজস্ব বাজেটের প্রধান অর্থ সংস্থান আসে নিয়মিত আয়ের উৎস থেকে, যেমন— বিভিন্ন ধরনের কর (আয়কর, ভ্যাট, শুল্ক), সরকারি ফি এবং জরিমানা। এই আয়গুলো সাধারণত সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানোর জন্য যথেষ্ট হয়। অপরদিকে, মূলধনী বাজেটের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রায়শই ঋণ গ্রহণ, সরকারি বন্ড বিক্রি, এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অনুদানের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এই ধরনের অর্থ সংগ্রহ দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য জরুরি, কারণ রাজস্ব আয় দিয়ে এত বড় অঙ্কের ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না।
৩. সম্পদ সৃষ্টি: রাজস্ব বাজেট কোনো নতুন সম্পদ সৃষ্টি করে না বা সরকারের সম্পদ হ্রাস করে না। এর প্রধান লক্ষ্য হলো চলমান ব্যয় নির্বাহ করা। উদাহরণস্বরূপ, যখন সরকার কোনো ভর্তুকি প্রদান করে বা কর্মচারীদের বেতন দেয়, তখন এর মাধ্যমে কোনো নতুন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি তৈরি হয় না। পক্ষান্তরে, মূলধনী বাজেটের প্রতিটি খরচই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নতুন সম্পদ তৈরি করে। একটি নতুন রেললাইন তৈরি, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অথবা সরকারি ভবন তৈরি— এই সবই মূলধনী ব্যয়ের আওতায় পড়ে, যা দেশের সম্পদ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
৪. মেয়াদকাল: রাজস্ব বাজেটের হিসাব সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অর্থ বছরের জন্য করা হয়। এই বাজেট স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে এবং বছরের শেষে এর হিসাব শেষ হয়ে যায়। পরের বছর নতুন করে আবার রাজস্ব বাজেট প্রণয়ন করা হয়। এর বিপরীতে, মূলধনী বাজেট দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে। একটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প যেমন সেতু বা বাঁধ নির্মাণ করতে কয়েক বছর বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে। তাই মূলধনী ব্যয়ের ফল সাধারণত কয়েক বছর পর পর্যায়ক্রমে পাওয়া যায়, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে অবদান রাখে।
৫. প্রভাবের ধরণ: রাজস্ব ব্যয়ের প্রভাব মূলত তাৎক্ষণিক এবং সমাজের দৈনন্দিন জীবনে পরিলক্ষিত হয়। যেমন— ভর্তুকি বা সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা সরাসরি মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এই ব্যয়গুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি বা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে না। অন্যদিকে, মূলধনী ব্যয়ের প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। একটি নতুন হাইওয়ে বা বন্দরের নির্মাণ দেশের বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করে, যা দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটায়।
৬. ঋণ গ্রহণ: যদি কোনো দেশের রাজস্ব আয় তার রাজস্ব ব্যয়ের চেয়ে কম হয়, তাহলে সেটি রাজস্ব ঘাটতি হিসেবে পরিচিত। এই ঘাটতি পূরণের জন্য সাধারণত অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হয়। এই ধরনের ঋণ প্রায়শই অনুৎপাদনশীল হয় এবং দেশের ঋণের বোঝা বৃদ্ধি করে। কিন্তু মূলধনী ব্যয়ের জন্য নেওয়া ঋণ সাধারণত উৎপাদনশীল হয়, কারণ এই অর্থ ব্যবহার করে এমন সম্পদ তৈরি করা হয়, যা ভবিষ্যতে আয় সৃষ্টি করতে পারে এবং ঋণের বোঝা হ্রাস করতে সাহায্য করে। এই কারণেই মূলধনী ব্যয়ের জন্য ঋণ গ্রহণকে প্রায়শই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়।
৭. প্রশাসনিক ব্যবস্থা: রাজস্ব বাজেট দেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এটি ছাড়া সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। প্রশাসনিক ব্যয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং বিভিন্ন সরকারি সেবার খরচ এই বাজেটের মাধ্যমে নির্বাহ হয়। তাই এটি একটি দেশের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। এর বিপরীতে, মূলধনী বাজেট দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করে। নতুন নতুন প্রকল্প এবং অবকাঠামো তৈরি করে এটি দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে।
উপসংহার: রাজস্ব বাজেট এবং মূলধনী বাজেট— দুটিই একটি দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও রাজস্ব বাজেট সরকারের চলমান কার্যক্রম এবং মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে সহায়তা করে, মূলধনী বাজেট দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ নিশ্চিত করে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য উভয় বাজেটের মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য। শুধুমাত্র রাজস্ব ব্যয়ের ওপর জোর দিলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে, আর শুধু মূলধনী ব্যয়ের ওপর জোর দিলে বর্তমানের প্রশাসনিক কার্যক্রম অচল হয়ে যেতে পারে। তাই একটি দেশের সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করতে হলে উভয় ধরনের বাজেটকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা করা উচিত।
- খরচের প্রকৃতি
- অর্থের উৎস
- সম্পদ সৃষ্টি
- মেয়াদকাল
- প্রভাবের ধরণ
- ঋণ গ্রহণ
- প্রশাসনিক ব্যবস্থা
২০১১ সালে বাংলাদেশের বাজেট ইতিহাসে প্রথমবার মূলধনী ব্যয়ের পরিমাণ রাজস্ব ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অতিক্রম করে, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের ক্রমবর্ধমান মনোযোগের প্রতিফলন ঘটায়। ২০০০-এর দশকে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ-এর জরিপে দেখা যায় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মূলধনী বাজেট বৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। ঔপনিবেশিক আমলের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে বাজেটের প্রধান অংশ ছিল রাজস্ব ব্যয়, তবে ১৯৫০-এর দশক থেকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় মূলধনী বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, যা দেশগুলোর শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে একটি নতুন দিকনির্দেশনা দেয়।

