- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা:- শিল্পায়িত সমাজ বলতে বোঝায় এমন একটি সমাজ যা প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং উৎপাদনক্ষমতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সাধন করেছে। এই সমাজের মূল ভিত্তি হলো শিল্পখাতের প্রাধান্য, যা কৃষিনির্ভরতা কমিয়ে আধুনিক জীবনযাত্রার পথ সুগম করে। শিল্পায়নের ফলে সমাজে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তির ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এটি মানুষের চিন্তাভাবনা ও জীবনযাপনের ধারাকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়। নিচে শিল্পায়িত সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।
১।প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার :- শিল্পায়িত সমাজে প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বত্র। কারখানায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ডিজিটালাইজেশন এই সমাজের প্রধান চালিকাশক্তি। ২০২১ সালের বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নত শিল্পায়িত দেশগুলোর ৮৫% শিল্পখাত প্রযুক্তিনির্ভর। রোবটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে বহুগুণ। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের শ্রম ও সময় দুটিই সাশ্রয় হচ্ছে।
২।নগরায়ণের প্রসার :- শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণের গতি ত্বরান্বিত হয়। ২০২০ সালের ইউনাইটেড নেশনসের তথ্য মতে, বিশ্বের ৫৬% মানুষ শহরে বাস করে, যা ১৯৫০ সালে ছিল মাত্র ৩০%। শিল্পকারখানা ও চাকরির সুযোগের জন্য মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে। এর ফলে শহরগুলো জনবহুল হয়ে ওঠে এবং নাগরিক সুবিধার চাহিদা বাড়ে। তবে নগরায়ণের ফলে বস্তি, যানজট ও পরিবেশ দূষণের মতো সমস্যাও দেখা দেয়।
৩।শিক্ষার হার বৃদ্ধি :- শিল্পায়িত সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১৯ সালের ইউনেস্কোর জরিপ অনুযায়ী, শিল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৫% শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে। কারিগরি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পায়, যা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষাও জনপ্রিয় হয়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তা শেখে, যা সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
৪।অর্থনৈতিক বৈষম্য :- শিল্পায়নের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলেও বৈষম্য বাড়ে। ২০২২ সালের অক্সফাম রিপোর্টে দেখা গেছে, বিশ্বের ১০% ধনী ব্যক্তি ৭৬% সম্পদের মালিক। শিল্পায়িত দেশেও ধনী-গরীবের ব্যবধান প্রকট। উচ্চবিত্তরা প্রযুক্তি ও শিল্পের সুবিধা ভোগ করলেও নিম্নবিত্তরা পিছিয়ে থাকে। সরকারি নীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এই বৈষম্য কমাতে সাহায্য করে।
৫।মহিলাদের কর্মসংস্থান :- শিল্পায়িত সমাজে নারীরা কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ২০২১ সালের আইএলও (ILO) প্রতিবেদন অনুসারে, উন্নত দেশগুলোর ৬৮% মহিলা চাকরি বা ব্যবসায় নিয়োজিত। কারখানা, অফিস, হাসপাতাল, স্কুল—সবক্ষেত্রেই নারীরা সমানভাবে কাজ করছে। তবে বেতনবৈষম্য ও লিঙ্গসমতা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নারীশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেলে সমাজ আরও এগিয়ে যাবে।
৬।স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন :- শিল্পায়নের ফলে চিকিৎসাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ২০২০ সালের ডব্লিউএইচও (WHO) তথ্য মতে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর গড় আয়ু ৭৮ বছর, যা উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে ১০ বছর বেশি। আধুনিক হাসপাতাল, ভ্যাকসিন, সার্জারি এবং গবেষণার মাধ্যমে মরণব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে দূষণ ও মানসিক চাপের কারণে নতুন রোগও দেখা দিচ্ছে।
৭।জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন :- শিল্পায়িত সমাজে মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত। বাড়ি, গাড়ি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট—এসব এখন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে দেখা গেছে, শিল্পোন্নত দেশের মানুষ বেশি সুখী। তবে ব্যস্ত জীবনযাত্রা, একাকীত্ব ও প্রতিযোগিতা মানুষের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে।
৮।সাংস্কৃতিক পরিবর্তন :- শিল্পায়নের ফলে সমাজের সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি কমে গিয়ে আধুনিকতা বৃদ্ধি পায়। সোশ্যাল মিডিয়া, গ্লোবালাইজেশন এবং বহুজাতিক সংস্কৃতি মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। ২০১৮ সালের গ্যালাপ জরিপে দেখা গেছে, তরুণরা এখন পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে বেশি ঝুঁকছে।
৯।পরিবেশ দূষণ :- শিল্পায়নের নেতিবাচক দিক হলো পরিবেশ দূষণ। কার্বন নিঃসরণ, প্লাস্টিক বর্জ্য এবং রাসায়নিক দূষণ প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ২০১৯ সালের EPA রিপোর্ট অনুযায়ী, শিল্পখাত ৪৫% কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে। সবুজ শিল্প ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার এই সমস্যা সমাধানের পথ দেখাচ্ছে।
১০।গবেষণা ও উদ্ভাবন :- শিল্পায়িত সমাজে গবেষণা ও উদ্ভাবনের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয় নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারে। ২০২২ সালের UNESCO তথ্য মতে, শিল্পোন্নত দেশগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ৭৫% বিনিয়োগ করে। এই উদ্ভাবন চিকিৎসা, যোগাযোগ ও শিল্পক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে।
উপসংহার:- শিল্পায়িত সমাজ আধুনিক সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর ইতিবাচক দিক যেমন উন্নত জীবনযাত্রা, প্রযুক্তি ও শিক্ষা, তেমনি নেতিবাচক দিক যেমন দূষণ ও বৈষম্য রয়েছে। ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলে শিল্পায়িত সমাজ আরও সমৃদ্ধ হবে। মানুষের কল্যাণে শিল্পের সঠিক ব্যবহারই হলো কাম্য।
🔹 প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার
🔹 নগরায়ণের প্রসার
🔹 শিক্ষার হার বৃদ্ধি
🔹 অর্থনৈতিক বৈষম্য
🔹 মহিলাদের কর্মসংস্থান
🔹 স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন
🔹 জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন
🔹 সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
🔹 পরিবেশ দূষণ
🔹 গবেষণা ও উদ্ভাবন
শিল্পায়নের সূচনা হয় ১৮শ শতকে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে। ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, কটন মিল এবং রেলওয়ে শিল্পকে বদলে দেয়। ২০শ শতকে আমেরিকা, জাপান ও জার্মানি শিল্পক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। ২০২৩ সালের ম্যাকিন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, বৈশ্বিক জিডিপির ৩০% আসে শিল্পখাত থেকে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

