- readaim.com
- 0

উপস্থাপনা:- সংস্কৃতি মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতি, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। তবে এই পরিবর্তন সব সময় একই পথে বা একই গতিতে হয় না। সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন সংস্কৃতির এই অসম অগ্রগতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব প্রদান করেছেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সংস্কৃতির দুটি প্রধান দিক – বস্তুগত সংস্কৃতি (যেমন যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি) এবং অবস্তুগত সংস্কৃতি (যেমন রীতিনীতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস) – বিভিন্ন গতিতে পরিবর্তিত হয়। বস্তুগত সংস্কৃতি দ্রুত পরিবর্তিত হলেও, অবস্তুগত সংস্কৃতি সেই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে ধীরগতিতে চলে। এই কারণে সমাজে একটি ভারসাম্যহীনতা বা “সাংস্কৃতিক ব্যবধান” (Cultural Lag) সৃষ্টি হয়।
অগবার্নের এই তত্ত্বটি সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসেবে বিবেচিত হয়। সংস্কৃতির পরিবর্তন এবং সমাজের উপর এর প্রভাব বুঝতে এই তত্ত্বটি সহায়ক। আসুন, আমরা অগবার্নের এই তত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ:-
১.বস্তুগত সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তন: অগবার্নের মতে, বস্তুগত সংস্কৃতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি এবং জীবনযাত্রার উপকরণ প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, উনিশ শতকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর পরিবহন ও শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এরপর বিদ্যুৎ, টেলিফোন, কম্পিউটার এবং বর্তমানে ইন্টারনেট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রায় দ্রুত পরিবর্তন এনেছে।
২.অবস্তুগত সংস্কৃতির ধীর পরিবর্তন: অন্যদিকে, অবস্তুগত সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে পরিবর্তিত হয়। মানুষের রীতিনীতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, প্রথা এবং সামাজিক নিয়মকানুন সহজে পরিবর্তিত হতে চায় না। এগুলো দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্য এবং সমাজের গভীরে প্রোথিত থাকে। কোনো নতুন প্রযুক্তি বা বস্তুগত পরিবর্তন সমাজে এলেও, মানুষজন তাদের পুরনো ধ্যানধারণা ও অভ্যাসের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না।
৩.সাংস্কৃতিক ব্যবধানের সৃষ্টি: বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির এই অসম গতির কারণেই সমাজে “সাংস্কৃতিক ব্যবধান” সৃষ্টি হয়। নতুন প্রযুক্তি বা বস্তুগত উদ্ভাবন সমাজে নতুন পরিস্থিতি তৈরি করে, কিন্তু সেই পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে মানুষের আচার-আচরণ, সামাজিক নিয়মকানুন বা মূল্যবোধ দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে না। ফলে একটি ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
৪.প্রযুক্তির প্রভাব: প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বস্তুগত সংস্কৃতির পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি। ১৮শ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব থেকে শুরু করে বর্তমানের তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লব পর্যন্ত, প্রতিটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সমাজের বস্তুগত দিককে দ্রুত পরিবর্তন করেছে। নতুন নতুন শিল্প, উৎপাদন প্রক্রিয়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।
৫.সামাজিক রীতিনীতির স্থিতিশীলতা: সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা এবং মূল্যবোধ দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য বহন করে। এগুলো সহজে পরিবর্তিত হয় না কারণ এগুলো সমাজের মানুষের বিশ্বাস ও অভ্যাসের সাথে গভীরভাবে যুক্ত থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই রীতিনীতিগুলো নতুন পরিস্থিতির সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে না।
৬.মূল্যবোধের পরিবর্তন: মূল্যবোধের পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। সমাজের মানুষের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কিত ধারণাগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। নতুন কোনো প্রযুক্তি বা বস্তুগত পরিবর্তন সমাজে এলেও, মানুষের মূল্যবোধ রাতারাতি পরিবর্তিত হয় না।
৭.আইন ও শাসনের ধীর পরিবর্তন: সমাজের নিয়মকানুন ও আইনকানুন সাধারণত বস্তুগত পরিবর্তনের সাথে সাথে দ্রুত পরিবর্তিত হয় না। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বা সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়, কারণ প্রচলিত আইন সেই নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অপ্রতুল হতে পারে।
৮. শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা: শিক্ষাব্যবস্থা অবস্তুগত সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নতুন প্রজন্মের মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা অপরিহার্য। তবে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনও সাধারণত ধীর গতিতে হয় এবং অনেক সময় তা বস্তুগত পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে পারে না।
৯.যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভাব: যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে সাহায্য করে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের ফলে তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এর ফলে অবস্তুগত সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এলেও তা বস্তুগত পরিবর্তনের গতির তুলনায় ধীর।
১০.শহরায়নের প্রভাব: শহরায়ন বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটায়। শহরে নতুন প্রযুক্তি ও জীবনযাত্রার পদ্ধতির দ্রুত প্রসার ঘটে। তবে শহরের মানুষের সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের পরিবর্তন প্রায়শই ধীর গতিতে হয়ে থাকে।
১১.শিল্পায়নের প্রভাব: শিল্পায়ন উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা বস্তুগত সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে শিল্পায়নের ফলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রা, সামাজিক সম্পর্ক এবং মূল্যবোধের পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটে।
১২.বৈশ্বিক সংস্কৃতির প্রভাব: বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি একে অপরের সংস্পর্শে আসছে। উন্নত দেশগুলোর বস্তুগত সংস্কৃতি দ্রুত অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু সেই তুলনায় অবস্তুগত সংস্কৃতির পরিবর্তন ধীর গতিতে হচ্ছে।
১৩.প্রজন্মগত ব্যবধান: বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের পার্থক্য এবং মূল্যবোধের ভিন্নতার কারণে সাংস্কৃতিক ব্যবধান দেখা দিতে পারে। নতুন প্রজন্ম দ্রুত প্রযুক্তির সাথে মানিয়ে নিলেও, older generation অনেক সময় সেই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে সমস্যায় পড়ে।
১৪.সামাজিক অস্থিরতা: সাংস্কৃতিক ব্যবধানের ফলে সমাজে অস্থিরতা ও সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। যখন মানুষের প্রত্যাশা এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়, তখন সামাজিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে।
১৫.মানসিক স্বাস্থ্য: দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। প্রযুক্তি আসক্তি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং নতুনত্বের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চাপ মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে পারে।
১৬.নৈতিক অবক্ষয়: অনেক সময় বস্তুগত উন্নতির সাথে সাথে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিতে পারে। প্রযুক্তির অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং সামাজিক অবিচারের মতো সমস্যাগুলো সাংস্কৃতিক ব্যবধানের ফল হতে পারে।
১৭.পরিবেশের উপর প্রভাব: দ্রুত বস্তুগত উন্নয়নের ফলে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। শিল্পায়ন ও প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের depletion দেখা দিতে পারে।
১৮.নীতি নির্ধারণের জটিলতা: সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কারণে নীতি নির্ধারণে জটিলতা সৃষ্টি হয়। সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের এমন নীতি প্রণয়ন করতে হয় যা বস্তুগত উন্নয়ন এবং সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।
১৯.অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তা: সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে অভিযোজন জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক সচেতনতা এবং নমনীয় নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এই ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব।
২০.গবেষণার গুরুত্ব: সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার জন্য নিয়মিত গবেষণা প্রয়োজন। এই গবেষণার মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
২১.সামাজিক পরিবর্তনের পূর্বাভাস:- অগবার্নের তত্ত্বটি ব্যবহার করে ভবিষ্যতের সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। বস্তুগত উন্নয়নের ধারা এবং অবস্তুগত সংস্কৃতির পরিবর্তনের গতি বিশ্লেষণ করে সমাজের সম্ভাব্য সমস্যা ও সুযোগ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
পরিসমাপ্তি:- পরিশেষে বলা যায়, অগবার্নের সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি তত্ত্বটি সমাজ পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করে। বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যেকার এই ব্যবধান সমাজে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সচেতনতা, সঠিক নীতি নির্ধারণ এবং অভিযোজনের মাধ্যমে এই ব্যবধান কমিয়ে একটি স্থিতিশীল ও উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব।
বস্তুগত সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তন, অবস্তুগত সংস্কৃতির ধীর পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক ব্যবধানের সৃষ্টি, প্রযুক্তির প্রভাব, সামাজিক রীতিনীতির স্থিতিশীলতা, মূল্যবোধের পরিবর্তন, আইন ও শাসনের ধীর পরিবর্তন, শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা, যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভাব, শহরায়নের প্রভাব, শিল্পায়নের প্রভাব, বৈশ্বিক সংস্কৃতির প্রভাব, প্রজন্মগত ব্যবধান, সামাজিক অস্থিরতা, মানসিক স্বাস্থ্য, নৈতিক অবক্ষয়, পরিবেশের উপর প্রভাব, নীতি নির্ধারণের জটিলতা, অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তা, গবেষণার গুরুত্ব, সামাজিক পরিবর্তনের পূর্বাভাস।
উনিশ শতকের শিল্প বিপ্লব (আনুমানিক ১৭৬০-১৮৪০) বস্তুগত সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। বিংশ শতাব্দীতে তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লব (১৯৭০-বর্তমান) যোগাযোগ ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীর জরিপ অনুযায়ী, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও, মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ এবং রীতিনীতি সেই তুলনায় ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্মার্টফোনের ব্যবহার গত দুই দশকে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এর ব্যবহারের সামাজিক ও নৈতিক প্রভাব নিয়ে বিতর্ক এখনও বিদ্যমান। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, যখনই কোনো নতুন প্রযুক্তি সমাজে এসেছে, তখন সমাজের অবস্তুগত দিক তার সাথে মানিয়ে নিতে সময় নিয়েছে এবং এর ফলে কিছু সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে।