- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতিতে ভোক্তা কীভাবে তার সীমিত অর্থ দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্য ক্রয় করে সর্বাধিক তৃপ্তি লাভ করতে পারে, তা সমপ্রান্তিক উপযোগ বিধির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়। এই বিধি অনুযায়ী, ভোক্তা প্রতিটি দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ ও দামের অনুপাত সমান করে ভোগ করে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ কিছু সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়।
মনে করি একজন ভোক্তা ৫ টাকা দিয়ে কলা ও পেয়ারা ক্রয় করতে ইচ্ছুক। সে যদি পাঁচ টাকা কলা ক্রয়ে ব্যায় করতে চায় তবে মোট উপযোগ পাবে ৬৮ এককের সমান এবং সে যদি পাঁচ টাকা পেয়ারা ক্রয়ে ব্যায় করে তা হলে মোট উপযোগ পাবে ৫৪ এককের সমান। কিন্তু সর্বাধিক তৃপ্তি পেতে হলে তাকে পাঁচ টাকা এমনভাবে কলা ও পেয়ার ক্রয়ে ব্যায় করতে হবে যাতে প্রতিটি দ্রব্য থেকে সমান উপযোগ পায়। বিষয়টি নিম্নে একটি টেবিলে সূচিচিত্রের মাধ্যমে দেখান হল-
ক্র. | টাকার পরিমাণ | প্রান্তিক উপযোগ (কলা) | প্রান্তিক উপযোগ (পেয়ারা) |
১ | ১ টাকা | ২০ | ১৬ |
২ | ২ টাকা | ১৮ | ১৪ |
৩ | ৩ টাকা | ১৪ | ১২ |
৪ | ৪ টাকা | ১০ | ০৮ |
৫ | ৫ টাকা | ৬ | ০৪ |
৬ | – | মোট উপযোগ = ৬৮ | মোট উপযোগ = ৫৪ |
উপরিউক্ত সূচি অনুযায়ী যদি ভোক্তা ৩ টাকা কলা এবং ২ টাকা পেয়ারা ক্রয়ে ব্যায় করে তবে উভয় ক্ষেত্রে প্রান্তিক উপযোগ হবে ১৪ এককের সমান এবং মোট উপযোগ হবে (২০ + ১৮ + ১৪ + ১৬ + ১৪) = ৮২ এককের সমান, যা সর্বাধিক উপযোগ নির্দেশ করে এখানেই ভোক্তার ভারসাম্য অবস্থা নির্ধারিত হবে। আর এই বিধিটিই সমপ্রান্তিক উপযোগ বিধি নামে পরিচিত।
১।অবাস্তব ধারণা: সমপ্রান্তিক উপযোগ বিধিটি কিছু অবাস্তব অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন, ভোক্তার আয়, অভ্যাস, রুচি ও দ্রব্যের দাম স্থির থাকবে বলে ধরে নেওয়া হয়, যা বাস্তবে পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতার কারণে বিধিটি সঠিকভাবে কার্যকর হতে পারে না এবং এটি একটি তাত্ত্বিক ধারণা হিসেবেই থেকে যায়।
২।সংখ্যাগত পরিমাপ: এই বিধি অনুযায়ী, উপযোগকে সংখ্যায় পরিমাপ করা যায় বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু উপযোগ একটি মানসিক ধারণা, যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। এটিকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে পর্যায়গতভাবে পরিমাপ করা গেলেও ১, ২, ৩ এভাবে সংখ্যায় প্রকাশ করা অবাস্তব, যা এই বিধির অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা।
৩।ভোক্তার অজ্ঞতা: অনেক সময় ভোক্তা বাজারের সব পণ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানে না। পণ্যের গুণাগুণ, সঠিক দাম এবং কোথায় পাওয়া যাবে, এসব তথ্যের অভাবে ভোক্তা তার অর্থ সঠিকভাবে বন্টন করতে পারে না। ফলে সব দ্রব্য থেকে সমান উপযোগ লাভ করা সম্ভব হয় না এবং বিধিটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
৪।অবিবেচনাপ্রসূত ক্রয়: সব ভোক্তা সব সময় বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বা হিসাব করে পণ্য কেনে না। অনেক সময় আবেগ, অভ্যাস বা অনুকরণপ্রিয়তার বশবর্তী হয়েও মানুষ কেনাকাটা করে। এসব ক্ষেত্রে প্রান্তিক উপযোগ বিবেচনা করে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ থাকে না, ফলে এই বিধিটি সেখানে প্রয়োগ করা যায় না।
৫।দ্রব্যের অবিভাজ্যতা: সমপ্রান্তিক উপযোগ বিধি প্রয়োগের একটি বড় সমস্যা হলো অনেক দ্রব্য অবিভাজ্য। যেমন— টেলিভিশন, ফ্রিজ, বা আসবাবপত্র ইত্যাদি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে কেনা যায় না। ফলে এই দ্রব্যগুলোর প্রান্তিক উপযোগ অন্যান্য দ্রব্যের সাথে সমান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, যা বিধিটির কার্যকারিতা হ্রাস করে।
৬।অর্থের প্রান্তিক উপযোগ: এই বিধিতে ধরে নেওয়া হয় যে, অর্থের প্রান্তিক উপযোগ স্থির থাকে। কিন্তু বাস্তবে ধনী ও গরিবের কাছে অর্থের প্রান্তিক উপযোগ এক নয়। একজন ধনী ব্যক্তির কাছে ১০০ টাকার যে মূল্য, একজন গরিবের কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই অর্থের প্রান্তিক উপযোগ স্থির না হওয়ায় বিধিটি বাস্তবে কার্যকর হয় না।
৭।স্থায়িত্বের অভাব: মানুষের রুচি, পছন্দ ও অভ্যাস প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আজ যা মানুষের কাছে আকর্ষণীয়, কাল তা নাও থাকতে পারে। এই পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন দ্রব্যের উপযোগও পরিবর্তিত হয়। ফলে ভোক্তা বিভিন্ন দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ সমান করতে পারে না এবং বিধিটি প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৮।পরিপূরক দ্রব্য: কিছু দ্রব্য আছে যেগুলো এককভাবে ব্যবহার করা যায় না, বরং অন্য দ্রব্যের সাথে একত্রে ব্যবহার করতে হয়। যেমন— কালি ছাড়া কলম বা পেট্রোল ছাড়া গাড়ি অচল। এসব পরিপূরক দ্রব্যের ক্ষেত্রে একটির উপযোগ অন্যটির উপর নির্ভরশীল হওয়ায় আলাদাভাবে প্রান্তিক উপযোগ নির্ণয় করা যায় না এবং বিধিটি প্রয়োগ করা অসম্ভব।
৯।বিকল্প দ্রব্যের অভাব: বাজারে যদি কোনো দ্রব্যের উপযুক্ত বিকল্প না থাকে, তবে ভোক্তাকে বাধ্য হয়ে সেই দ্রব্যটিই ক্রয় করতে হয়। এক্ষেত্রে অন্যান্য দ্রব্যের সাথে প্রান্তিক উপযোগ তুলনা করার কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে ভোক্তা তার ইচ্ছা অনুযায়ী অর্থ ব্যয় করে উপযোগ সমান করতে পারে না, যা এই বিধির একটি বড় সীমাবদ্ধতা।
১০।সীমাবদ্ধ বাজার: এই বিধিটি পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার জন্য একটি অবাধ বাজার প্রয়োজন, যেখানে সব ধরনের পণ্য সব সময় পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় বাজার সীমাবদ্ধ থাকে এবং চাহিদা অনুযায়ী সব পণ্য পাওয়া যায় না। এর ফলে ভোক্তা তার পছন্দ অনুযায়ী ভোগ করতে পারে না এবং বিধিটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
১১।অনির্দিষ্ট ভোগকাল: সমপ্রান্তিক উপযোগ বিধিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে মানুষের ভোগকাল অনির্দিষ্ট। মানুষ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সঞ্চয় করে এবং সব অর্থ বর্তমান ভোগে ব্যয় করে না। এই সঞ্চয়ের প্রবণতা বিধিটির কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করে, কারণ ভবিষ্যতের উপযোগ বর্তমানের সাথে মেলানো যায় না।
১২।কর আরোপ: সরকার যখন কোনো দ্রব্যের উপর কর আরোপ করে, তখন তার দাম বেড়ে যায়। ফলে সেই দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ ও দামের অনুপাত পরিবর্তিত হয়। ভোক্তা তখন তার ভোগ সমন্বয় করতে বাধ্য হয়। এই করের প্রভাবের কারণে বিধিটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, কারণ এটি বাহ্যিক হস্তক্ষেপ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
১৩।প্রদর্শনী প্রভাব: অনেক সময় মানুষ অন্যকে দেখানোর জন্য বা সমাজে নিজের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য দামী জিনিস ক্রয় করে। একে প্রদর্শন প্রভাব বলে। এক্ষেত্রে উপযোগের চেয়ে সামাজিক মর্যাদা বড় হয়ে দেখা দেয়। ফলে ভোক্তা প্রান্তিক উপযোগ বিচার না করে শুধু লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে, যা এই বিধির কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে।
১৪।উৎপাদন ও বিনিয়োগ: এই বিধিটি শুধুমাত্র ভোগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ উৎপাদন ও বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়। এইসব ক্ষেত্রে উপযোগের চেয়ে মুনাফা বা আয় বৃদ্ধির বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পায়। তাই উৎপাদন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই বিধিটি একেবারেই প্রয়োগযোগ্য নয়।
উপসংহার: যদিও সমপ্রান্তিক উপযোগ বিধির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং এটি বাস্তব জীবনে পুরোপুরি প্রয়োগ করা কঠিন, তবুও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই বিধিটি ভোক্তাদের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে কীভাবে সর্বাধিক তৃপ্তি অর্জন করা যায়, সে সম্পর্কে একটি তাত্ত্বিক ধারণা দেয়। এটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়।
🎨 ১। অবাস্তব ধারণা 🔢 ২। সংখ্যাগত পরিমাপ ❓ ৩। ভোক্তার অজ্ঞতা 🤔 ৪। অবিবেচনাপ্রসূত ক্রয় 🧩 ৫। দ্রব্যের অবিভাজ্যতা 💰 ৬। অর্থের প্রান্তিক উপযোগ ⏳ ৭। স্থায়িত্বের অভাব 🔗 ৮। পরিপূরক দ্রব্য 🚫 ৯। বিকল্প দ্রব্যের অভাব 🛒 ১০। সীমাবদ্ধ বাজার 📆 ১১। অনির্দিষ্ট ভোগকাল 🧾 ১২। কর আরোপ 🎭 ১৩। প্রদর্শনী প্রভাব 📈 ১৪। উৎপাদন ও বিনিয়োগ।
সমপ্রান্তিক উপযোগ ধারণাটি মূলত হেইনরিখ গোসেনের ১৮৫৪ সালের একটি সূত্রের উপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছে, যা পরবর্তীতে আলফ্রেড মার্শাল তার ১৮৯০ সালের প্রভাবশালী গ্রন্থ “Principles of Economics”-এ জনপ্রিয় করেন। বিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিবিদরা, যেমন জন হিকস, এই ধারণার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে এটিকে “অর্ডিনাল ইউটিলিটি” বা পর্যায়গত উপযোগ তত্ত্বের মাধ্যমে আরও বাস্তবসম্মত করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত ভোক্তা আচরণ জরিপে দেখা গেছে যে, জরুরি প্রয়োজন বা আকস্মিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে মানুষ প্রায়ই প্রান্তিক উপযোগের মতো জটিল হিসাব অনুসরণ করে না, যা এই তত্ত্বের প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে।

