- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা:-মানুষ সামাজিক জীব। নানা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে আমরা একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র। এই স্বতন্ত্রতা যখন দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়, আচার-আচরণে, এমনকি চিন্তাভাবনার ধরনে ভিন্নতা নিয়ে আসে, তখন তৈরি হয় এক ধরনের দূরত্ব। এই দূরত্বই মূলত সাংস্কৃতিক ব্যবধান নামে পরিচিত। আসুন, সহজ ভাষায় এই আকর্ষণীয় বিষয়টি সম্পর্কে আরও কিছু জেনে নেওয়া যাক।
সাংস্কৃতিক ব্যবধান- এর সজ্ঞা:-
সহজ কথায় বলতে গেলে, সাংস্কৃতিক ব্যবধান হলো দুটি ভিন্ন সংস্কৃতি বা সমাজের মানুষের মধ্যেকার পার্থক্য। এই পার্থক্যগুলো মূল্যবোধ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, যোগাযোগ শৈলী, এমনকি প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে। যখন কোনো ব্যক্তি বা দল এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে যায়, তখন এই ব্যবধান তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, অস্বস্তি বা এমনকি সংঘাতের কারণও হতে পারে।
সাধারণভাবে আমরা যখন সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কথা ভাবি, তখন হয়তো মনে করি এটি কেবল পোশাক-আশাক বা খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য। তবে এর গভীরতা অনেক বেশি। মানুষের চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধানের ধরণ, সময়জ্ঞান, ব্যক্তিগত স্থান এবং যোগাযোগের পদ্ধতিও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলোই আসলে দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে একে অপরের কাছে ‘ভিন্ন’ করে তোলে।
বিভিন্ন বিজ্ঞানী, মনীষী, গবেষক ও অধ্যাপক সাংস্কৃতিক ব্যবধানকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিচে তাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা ইংরেজি নামসহ উল্লেখ করা হলো:-
১. এডওয়ার্ড টি. হল (Edward T. Hall): “সংস্কৃতি হলো যোগাযোগের নীরব ভাষা।” (Culture is a silent language.) তাঁর মতে, সাংস্কৃতিক ব্যবধান মূলত বিভিন্ন সংস্কৃতিতে যোগাযোগের পদ্ধতি এবং প্রেক্ষাপট বোঝার ভিন্নতার কারণে সৃষ্টি হয়।
২. ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ (Clifford Geertz): “সংস্কৃতি হলো ঐতিহাসিকভাবে সঞ্চিত নকশার একটি ব্যবস্থা, যা প্রতীকায়িত রূপে মূর্ত এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধারণা, মূল্যবোধ এবং জ্ঞানকে প্রকাশ করে; এটি আচরণের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে।” (Culture is a system of inherited conceptions expressed in symbolic forms by means of which people communicate, perpetuate, and develop their knowledge about and attitudes toward life.) গিয়ার্টজের মতে, সাংস্কৃতিক ব্যবধান এই প্রতীকী অর্থ এবং ব্যাখ্যার ভিন্নতার ফল।
৩. গিয়ার্ট হোফস্টেড (Geert Hofstede): “সংস্কৃতি হলো মনের একটি সমষ্টিগত প্রোগ্রামিং যা একদল বা শ্রেণির মানুষকে অন্য দল বা শ্রেণির মানুষ থেকে আলাদা করে।” (Culture is the collective programming of the mind that distinguishes the members of one group or category of people from others.) হোফস্টেডের সাংস্কৃতিক মাত্রাতত্ত্ব (Cultural Dimensions Theory) সাংস্কৃতিক ব্যবধান বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো প্রদান করে।
৪. ফান্স ট্রোমপেনার্স (Fons Trompenaars): “সংস্কৃতি হলো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের একটি ভাগ করা উপায়।” (Culture is the way in which a group of people solves problems and reconciles dilemmas.) ট্রোমপেনার্সের মতে, বিভিন্ন সংস্কৃতি বিভিন্ন উপায়ে সমস্যা মোকাবেলা করে, যা সাংস্কৃতিক ব্যবধান তৈরি করে।
৫. রোনাল্ড ইংলহার্ট (Ronald Inglehart): “সংস্কৃতি হলো মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং নিয়মকানুনের একটি ব্যবস্থা যা একটি সমাজে ব্যাপকভাবে ভাগ করা হয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়।” (Culture is a system of values, beliefs, and norms that are widely shared within a society and transmitted from one generation to the next.) ইংলহার্টের মতে, মৌলিক মূল্যবোধের পার্থক্য সাংস্কৃতিক ব্যবধানের মূল কারণ।
৬. স্টেলা টিং-টুomey (Stella Ting-Toomey): “সংস্কৃতি হলো জ্ঞান, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নিয়মকানুন, রীতিনীতি, অভ্যাস এবং ভাষাগত সহভাগিতার একটি জটিল কাঠামো যা একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী ভাগ করে নেয়।” (Culture is a complex frame of reference that consists of a pattern of traditions, beliefs, values, norms, meanings, and symbols that are shared to varying degrees by interacting members of a community.) টিং-টুওমি যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ব্যবধানের প্রভাবের উপর জোর দেন।
উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে আমরা বলতে পারি যে, সাংস্কৃতিক ব্যবধান হলো বিভিন্ন সমাজের বা গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের মধ্যেকার জ্ঞান, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, যোগাযোগ পদ্ধতি এবং জীবনযাত্রার ধরনের সুস্পষ্ট পার্থক্য। এই পার্থক্যগুলো পারস্পরিক বোঝাপড়া ও মিথস্ক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
সামাপিকা:- পরিশেষে বলা যায়, সাংস্কৃতিক ব্যবধান একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বাড়ছে। এই ব্যবধান সম্পর্কে সচেতনতা এবং একে অপরের সংস্কৃতিকে সম্মান করার মাধ্যমেই একটি সহনশীল ও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব। সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে শত্রু হিসেবে না দেখে বরং নতুন কিছু শেখা ও জানার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সাংস্কৃতিক ব্যবধান হলো বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে থাকা পার্থক্য বা ভিন্নতা। এটি ভাষা, আচরণ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি এবং জীবনধারা সহ অনেক দিক থেকে হতে পারে।
সাংস্কৃতিক ব্যবধান হল বিভিন্ন সমাজের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচরণ ও জীবনধারার পার্থক্য। এটি সাধারণত ভাষা, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, এবং জীবনযাত্রার ধরনে প্রতিফলিত হয়। ২০০১ সালে, ইউনেস্কো তাদের “কনভেনশন অ্যান সিকিউরিং ডাইভারসিটি” রিপোর্টে সাংস্কৃতিক ব্যবধানের গুরুত্ব তুলে ধরেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল, সাংস্কৃতিক পার্থক্য সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, তবে এটি সঠিকভাবে পরিচালনা করা গেলে সামগ্রিক উন্নতি আসতে পারে। ২০১৩ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, সামাজিক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। তবে ২০২০ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক ব্যবধান কর্মক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন অসঙ্গত মানসিকতা এবং বৈষম্য।

