- readaim.com
- 0

উত্তর::সূচনা:- মানুষ সামাজিক জীব। জন্মগ্রহণের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সে সমাজের বিভিন্ন রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আচরণের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং ধীরে ধীরে সমাজের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই প্রক্রিয়াটিই হলো সামাজিকীকরণ। বিভিন্ন মাধ্যম এই সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আসুন, সহজ ভাষায় সেই মাধ্যমগুলো সম্পর্কে জেনে নিই। সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলো বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. পরিবার:- সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরিবারই তার প্রথম জগৎ। মা-বাবা, ভাই-বোন এবং অন্যান্য সদস্যদের সান্নিধ্যে শিশু হাঁটা, কথা বলা, খাদ্যাভ্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং প্রাথমিক সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। পরিবারের সদস্যদের আচরণ, কথাবার্তা ও মূল্যবোধ শিশুর মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তার ব্যক্তিত্বের ভিত্তি স্থাপন করে।
২. বিদ্যালয়:- পরিবার পেরিয়ে শিশু যখন বিদ্যালয়ে পদার্পণ করে, তখন সামাজিকীকরণের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বিদ্যালয় কেবল জ্ঞানার্জনের স্থান নয়, এটি একটি ছোট সমাজের প্রতিচ্ছবি। এখানে শিশুরা বিভিন্ন সামাজিক পটভূমির বন্ধুদের সাথে মিশে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, নিয়মানুবর্তিতা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলী অর্জন করে। শিক্ষকের আদর্শ ও পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে তারা সমাজের বৃহত্তর মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়।
৩. বন্ধুবান্ধব:- শৈশব ও কৈশোরে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ সামাজিকীকরণের একটি অপরিহার্য অংশ। সমবয়সীদের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের ভাবনা ও অনুভূতি ভাগ করে নেয়। তারা খেলার সাথী, আলোচনার সঙ্গী এবং বিপদে আপদে একে অপরের পাশে থাকে। এই সম্পর্কগুলো তাদের মধ্যে সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, সহনশীলতা এবং দলবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করে।
৪. গণমাধ্যম:- বর্তমান যুগে গণমাধ্যম সামাজিকীকরণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, সিনেমা এবং ইন্টারনেট মানুষের চিন্তা, চেতনা ও আচরণের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান, খবর, বিজ্ঞাপন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা মানুষ সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা, ফ্যাশন, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারে।
৫. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান:- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা প্যাগোডার মতো ধর্মীয় স্থানগুলোতে মানুষ একত্রিত হয় এবং ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও নৈতিক শিক্ষা লাভ করে। ধর্মীয় নেতারা ও ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে তারা ন্যায়-অন্যায়, কর্তব্য-অকর্তব্য এবং সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে।
৬. সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী:- বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী যেমন – নৃত্য, সঙ্গীত, নাটক বা আবৃত্তি দল সামাজিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই গোষ্ঠীগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশুরা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হয়। তারা দলবদ্ধভাবে কাজ করতে শেখে, অন্যের প্রতি সম্মান জানাতে এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে উৎসাহিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা বৃহত্তর সমাজের সাথে নিজেদের সংযোগ স্থাপন করে।
৭. কর্মক্ষেত্র:- প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে কর্মক্ষেত্র সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। এখানে বিভিন্ন পেশার ও বিভিন্ন সামাজিক পটভূমির মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। কর্মক্ষেত্রে নিয়মকানুন মেনে চলা, সহকর্মীদের সাথে সহযোগিতা করা এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সম্মিলিতভাবে কাজ করা সামাজিক আচরণের গুরুত্বপূর্ণ দিক। পদোন্নতি ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়।
৮. আইন ও বিচার ব্যবস্থা:- সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করতে আইন ও বিচার ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনের মাধ্যমে সমাজের মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। আইন অমান্য করলে শাস্তির বিধান থাকায় মানুষ সামাজিক norms ও মূল্যবোধ মেনে চলতে বাধ্য হয়।
৯. রাজনৈতিক দল ও সংগঠন:- রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন জনমত গঠন এবং সামাজিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংগঠনগুলোর মাধ্যমে মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়। রাজনৈতিক আলোচনা ও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত হয়।
১০. স্থানীয় সম্প্রদায়:- স্থানীয় সম্প্রদায় বা পাড়া-প্রতিবেশী সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম। দৈনন্দিন জীবনে একে অপরের সাথে মেলামেশা, সাহায্য-সহযোগিতা এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানুষ সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্ব অনুভব করে। স্থানীয় রীতিনীতি ও প্রথাগুলো ব্যক্তি জীবনে প্রভাব ফেলে এবং সামাজিক সংহতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
উপসংহার:- পরিশেষে বলা যায়, সামাজিকীকরণ একটি জটিল ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যম ব্যক্তির সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এই মাধ্যমগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে একজন ব্যক্তি সমাজের একজন উপযুক্ত ও দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে গড়ে ওঠে। সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সামাজিকীকরণের এই মাধ্যমগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য।
🔹 একনজরে সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলো দেখে নিন:-
- পরিবার
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
- সহপাঠী বা বন্ধু গোষ্ঠী
- গণমাধ্যম
- খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
- কর্মক্ষেত্র
- সামাজিক সংগঠন
- রাষ্ট্র ও সরকার
- প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর ৮০% সামাজিকীকরণ পরিবার ও বিদ্যালয়ে হয় (ইউনিসেফ, ২০২০)। বাংলাদেশে ৯৫% মানুষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিক শিক্ষা পায় (বিবিএস, ২০২১)। এছাড়া, ৭০% তরুণ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ব সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে (ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড, ২০২২)। সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলো সময়ের সাথে বদলাচ্ছে, কিন্তু এর গুরুত্ব কখনই কমছে না।