- readaim.com
- 0
উত্তর::সূচনা:- মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে বসবাসের জন্য কিছু নিয়মকানুন ও রীতিনীতি মেনে চলতে হয়। এই নিয়মকানুন ও রীতিনীতিগুলি বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান কাজ করে। এগুলোকেই সাধারণভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন বলা হয়। পরিবার, শিক্ষা, ধর্ম, আইন, জনমত, প্রথা, রীতিনীতি, ইত্যাদি এই সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখে। একটি স্থিতিশীল সমাজ গঠনে এই বাহনগুলির ভূমিকা অপরিসীম।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহনগুলির ভূমিকা
১.পরিবার: পরিবার হলো সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন। জন্মলগ্ন থেকে একটি শিশু পরিবারের মাধ্যমেই সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আচরণের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। মা-বাবা ও অন্যান্য সদস্যদের আচার-আচরণ, স্নেহ-ভালোবাসা, শাসন ও অনুশাসন শিশুর মধ্যে সামাজিক norms এবং values সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, শৈশবের সুষ্ঠু পারিবারিক পরিবেশ শিশুদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও নিয়মানুবর্তিতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২.শিক্ষা: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। বিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সমাজের নিয়মকানুন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পর্কে অবগত হয়। শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম, নাগরিক দায়িত্ব ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মতো গুণাবলী বিকশিত হয়। ২০১১ সালের বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
৩.ধর্ম: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বিশ্বাস মানুষের আচার-আচরণ ও মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ধর্মীয় অনুশাসন, রীতিনীতি এবং ধর্মীয় নেতাদের উপদেশ মানুষকে ন্যায় ও নীতিভিত্তিক জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। ধর্মীয় শাস্তির ভয় এবং পরকালে পুরষ্কারের আশা মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। Pew Research Center-এর ২০১৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধর্মীয়ভাবে সক্রিয় ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে অধিকতর নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন আচরণ প্রদর্শন করে।
৪.আইন: আইন হলো রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি। এটি সমাজের সকল সদস্যের জন্য বাধ্যতামূলক এবং এর লংঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। আইনের মাধ্যমে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয় এবং নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয়। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি এবং অন্যান্য আধুনিক আইন বাংলাদেশে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে।
৫.জনমত: জনমত একটি শক্তিশালী সামাজিক নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হিসেবে কাজ করে। সমাজের অধিকাংশ মানুষের সম্মিলিত মতামত বা ধারণা ব্যক্তির আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। সামাজিক রীতিনীতি বা প্রচলিত মূল্যবোধের পরিপন্থী কোনো কাজ করলে ব্যক্তি সমাজের সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে, যা তাকে তার আচরণ পরিবর্তনে বাধ্য করে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬.প্রথা ও রীতিনীতি: প্রথা ও রীতিনীতি হলো সমাজে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা আচার-ব্যবহারের নিয়ম। এগুলো লিখিত না হলেও সমাজের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে চলে। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, পোশাক পরিধান, অভিবাদন জানানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। উনিশ শতকের গ্রামীণ সমাজে প্রথা ও রীতিনীতির প্রভাব অত্যন্ত প্রবল ছিল।
৭.গণমাধ্যম: সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও এবং ইন্টারনেট সমাজের তথ্য প্রবাহের প্রধান উৎস। গণমাধ্যম সমাজের বিভিন্ন ঘটনা, সমস্যা ও মূল্যবোধকে জনগণের সামনে তুলে ধরে জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কোনো অন্যায় বা অসঙ্গতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা জনসমক্ষে সমালোচিত হয় এবং এর ফলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
৮.সামাজিক গোষ্ঠী ও সংগঠন: বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও সংগঠন, যেমন ক্লাব, সমিতি, সাংস্কৃতিক দল ইত্যাদি তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন ও মূল্যবোধের মাধ্যমে সদস্যদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই গোষ্ঠীগুলির সদস্যপদ ব্যক্তির সামাজিক পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রভাবিত করে, ফলে ব্যক্তি গোষ্ঠীর নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হয়।
৯.সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: সমাজের দীর্ঘদিনের লালিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যেমন লোকনৃত্য, গান, নাটক, সাহিত্য ইত্যাদি মানুষের মূল্যবোধ ও আচরণকে প্রভাবিত করে। এই ঐতিহ্যগুলির মাধ্যমে সমাজের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়।
১০.অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও সম্পদ বণ্টনের ধরণ মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে। দারিদ্র্য, বৈষম্য বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়।
১১.রাজনৈতিক ব্যবস্থা: একটি দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও শাসন ব্যবস্থা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ ও মত প্রকাশের সুযোগ সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে আরও কার্যকর করে তোলে।
১২.ভাষা: ভাষা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলেও এটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ভাষার মাধ্যমে সমাজের মূল্যবোধ, রীতিনীতি ও জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। ভাষার ব্যবহার সামাজিক সম্পর্ক ও শ্রেণীবিন্যাসকেও প্রতিফলিত করে।
১৩.পোশাক ও অলংকার: পোশাক ও অলংকার কেবল ব্যক্তিগত রুচির প্রকাশ নয়, এগুলো সামাজিক পরিচয় ও মর্যাদাও বহন করে। সমাজে প্রচলিত পোশাকরীতি ও অলংকার ব্যবহারের নিয়ম ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রভাবিত করে।
১৪.বিনোদন ও আমোদপ্রমোদ: সুস্থ বিনোদন ও আমোদপ্রমোদের মাধ্যম সমাজের মানুষকে একত্রিত করে এবং সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। তবে অশ্লীল বা অনৈতিক বিনোদন সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাতে পারে, যা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জন্য হুমকি স্বরূপ।
১৫.প্রযুক্তি: আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। একদিকে যেমন তথ্যের অবাধ প্রবাহের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে গুজব ও অপপ্রচারের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতাও সৃষ্টি হতে পারে।
১৬.স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা: একটি সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর সমাজ স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা জনগণের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে, যা পরোক্ষভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
১৭.কৃষি ও শিল্প: কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন এবং শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিক অসন্তোষ বা কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে সমাজে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপের প্রয়োজন।
১৮.স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা: শহরের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা সামাজিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। পরিকল্পিত নগরায়ন সামাজিক সংহতি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে, অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ন সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
১৯.আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: আন্তর্জাতিক নীতি ও বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
২০.ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: কোনো সমাজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ঐতিহ্য সেখানকার সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অতীতের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা বর্তমানের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আকার দেয়।
২১.জাতি ও গোষ্ঠী: একটি সমাজে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সহাবস্থান সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা বজায় থাকলে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
উপসংহার:- পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কোনো একক উপাদানের উপর নির্ভরশীল নয়। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় আইন পর্যন্ত বিভিন্ন বাহন সম্মিলিতভাবে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং মানুষের আচরণকে সমাজের প্রত্যাশিত পথে পরিচালিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বাহনগুলির কার্যকর ভূমিকা একটি সুস্থ, স্থিতিশীল ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনে অপরিহার্য। সময়ের সাথে সাথে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের এই মাধ্যমগুলির প্রকৃতি ও কার্যকারিতা পরিবর্তিত হতে পারে, তবে সমাজের সুশৃঙ্খল funcionamiento-এর জন্য এদের গুরুত্ব অপরিসীম।
পরিবার, শিক্ষা, ধর্ম, আইন, জনমত, প্রথা ও রীতিনীতি, গণমাধ্যম, সামাজিক গোষ্ঠী ও সংগঠন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ভাষা, পোশাক ও অলংকার, বিনোদন ও আমোদপ্রমোদ, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা, কৃষি ও শিল্প, স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, জাতি ও গোষ্ঠী।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় হামুরাবির কোড (খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০) প্রথম লিখিত আইন হিসেবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৯০ সালে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম সামাজিক নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব দেন। ২০২১ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, COVID-19 মহামারিতে সামাজিক দূরত্ব নিয়ম ৮০% দেশে অপরাধ হার কমিয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৬ সালে মোবাইল কোর্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দ্রুত বিচার ব্যবস্থা চালু হয়, যা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

