- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: চাহিদা হলো অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা। চাহিদা স্থির না থেকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, আর এই পরিবর্তনের মাত্রা বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করে। অর্থনীতিতে চাহিদার এই পরিবর্তনশীলতাকে স্থিতিস্থাপক এবং অস্থিতিস্থাপক এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই দুটি ধারণা একে অপরের থেকে ভিন্ন এবং এদের পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত জরুরি।
১। মূল্য সংবেদনশীলতা: স্থিতিস্থাপক চাহিদার ক্ষেত্রে, পণ্যের দাম সামান্য বাড়লে বা কমলে চাহিদার পরিমাণ অনেক বেশি পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে, অস্থিতিস্থাপক চাহিদার ক্ষেত্রে দামের পরিবর্তন চাহিদার ওপর খুব কম প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ, দাম বাড়লেও মানুষ সেই পণ্যটি কিনতে বাধ্য হয়, কারণ সেটির প্রয়োজন খুব বেশি। যেমন, বিলাস সামগ্রী বা অপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা সাধারণত স্থিতিস্থাপক হয়, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন চাল, ডাল, লবণ, ওষুধ ইত্যাদির চাহিদা অস্থিতিস্থাপক হয়।
২। বিকল্প পণ্যের সহজলভ্যতা: স্থিতিস্থাপক চাহিদার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো বিকল্প পণ্যের সহজলভ্যতা। যদি কোনো পণ্যের অনেক বিকল্প থাকে, তবে সেই পণ্যের দাম বাড়লে মানুষ সহজেই তার বিকল্প পণ্যটি কিনতে পারে, ফলে মূল পণ্যের চাহিদা কমে যায়। যেমন, চায়ের দাম বাড়লে মানুষ কফি পান করতে পারে। কিন্তু অস্থিতিস্থাপক চাহিদার ক্ষেত্রে এমন বিকল্প পণ্য সহজে পাওয়া যায় না। যেমন, ইনসুলিন বা জীবন রক্ষাকারী ওষুধের কোনো বিকল্প নেই, তাই দাম বাড়লেও এর চাহিদা প্রায় অপরিবর্তিত থাকে।
৩। আয়ের প্রভাব: সাধারণত, আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় এমন পণ্যের চাহিদা স্থিতিস্থাপক হয়। যেমন, একটি গাড়ি বা দামী ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দাম যদি বাড়ে, তবে তা ক্রেতার আয়ের ওপর বড় প্রভাব ফেলে, ফলে তারা কেনা থেকে বিরত থাকতে পারে। কিন্তু, আয়ের খুব সামান্য অংশ ব্যয় হয় এমন পণ্যের চাহিদা অস্থিতিস্থাপক হয়। যেমন, একটি দিয়াশলাইয়ের দাম বাড়লেও তা আয়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না, তাই এর চাহিদা প্রভাবিত হয় না।
৪। সময়কাল: দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে, পণ্যের চাহিদা সাধারণত স্থিতিস্থাপক হয়। কারণ মানুষ সময়ের সাথে নতুন বিকল্প খুঁজে নিতে পারে অথবা তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে। যেমন, পেট্রোলের দাম বাড়লে স্বল্প মেয়াদে চাহিদা কম নাও হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মানুষ ইলেকট্রিক গাড়ি বা অন্য কোনো বিকল্প বেছে নিতে পারে। পক্ষান্তরে, স্বল্প মেয়াদে পণ্যের চাহিদা প্রায়শই অস্থিতিস্থাপক হয়, কারণ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়।
৫। প্রয়োজনীয়তার মাত্রা: জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য বা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা সাধারণত অস্থিতিস্থাপক হয়। যেমন, বিদ্যুতের দাম বাড়লেও মানুষ তার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে পারে না। কিন্তু যেসব পণ্য জীবনের জন্য অপরিহার্য নয়, অর্থাৎ বিলাসিতার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর চাহিদা স্থিতিস্থাপক। যেমন, বিলাসবহুল কোনো ভ্রমণের খরচ বাড়লে মানুষ সহজেই সেটি বাতিল করতে পারে।
৬। ভোক্তার অভ্যাস: যদি কোনো পণ্য দীর্ঘকাল ধরে ভোক্তার অভ্যাসের অংশ হয়, তবে সেই পণ্যের চাহিদা অস্থিতিস্থাপক হয়। যেমন, ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সিগারেটের দাম বাড়লেও এর চাহিদা খুব বেশি কমে না। কিন্তু যে সকল পণ্যের ব্যবহার ভোক্তার অভ্যাসের সাথে যুক্ত নয়, সেগুলোর চাহিদা পরিবর্তনশীল বা স্থিতিস্থাপক হয়।
৭। বাজার পরিস্থিতি: একচেটিয়া বাজারের অধীনে থাকা পণ্যের চাহিদা সাধারণত অস্থিতিস্থাপক হয়, কারণ বিক্রেতা একজন হওয়ায় দাম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে। কিন্তু, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে থাকা পণ্যের চাহিদা স্থিতিস্থাপক হয়, কারণ এখানে ক্রেতাদের কাছে অনেক বিকল্প থাকে। বিক্রেতা দাম বাড়ালে ক্রেতারা অন্য বিক্রেতার কাছে চলে যেতে পারে।
৮। পণ্যের বৈশিষ্ট্য: যেসব পণ্যের দাম কম এবং যা সহজে পরিবহন করা যায়, সেগুলোর চাহিদা অস্থিতিস্থাপক হতে পারে। যেমন, রুটি বা দুধের দাম সামান্য বাড়লে তা খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। অন্যদিকে, যেসব পণ্যের দাম বেশি এবং যা সহজে পরিবহন করা যায় না, যেমন একটি ফ্রিজ বা টেলিভিশন, সেগুলোর চাহিদা স্থিতিস্থাপক হয়।
৯। চাহিদা রেখা: গ্রাফে চাহিদা রেখার ঢাল দেখেও স্থিতিস্থাপক ও অস্থিতিস্থাপক চাহিদার পার্থক্য বোঝা যায়। স্থিতিস্থাপক চাহিদার রেখা সাধারণত সমতল বা কম ঢালু হয়, যা ইঙ্গিত করে যে দামের সামান্য পরিবর্তন চাহিদার পরিমাণে বড় পরিবর্তন আনে। অপরদিকে, অস্থিতিস্থাপক চাহিদার রেখা খাড়া বা বেশি ঢালু হয়, যা বোঝায় যে দামের পরিবর্তন চাহিদা রেখার ওপর কম প্রভাব ফেলে।
উপসংহার: অর্থনীতিতে স্থিতিস্থাপক ও অস্থিতিস্থাপক চাহিদার ধারণা দুটি অত্যন্ত মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারণাগুলো শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস্তব জীবনেও এর ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। সরকারি কর নীতি থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক মূল্য নির্ধারণের কৌশল পর্যন্ত—সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই পার্থক্য সঠিকভাবে অনুধাবন করা গেলে অর্থনীতিতে বিভিন্ন পণ্যের আচরণ এবং বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি গভীর জ্ঞান লাভ করা সম্ভব।
১. মূল্য সংবেদনশীলতা ২. বিকল্প পণ্যের সহজলভ্যতা ৩. আয়ের প্রভাব ৪. সময়কাল ৫. প্রয়োজনীয়তার মাত্রা ৬. ভোক্তার অভ্যাস ৭. বাজার পরিস্থিতি ৮. পণ্যের বৈশিষ্ট্য ৯. চাহিদা রেখা।
১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল স্থিতিস্থাপকতার ধারণাটিকে জনপ্রিয় করেন। তিনি তার ‘প্রিন্সিপালস অফ ইকোনমিক্স’ গ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৯২৯ সালের মহামন্দার সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা অস্থিতিস্থাপক হওয়ায় মানুষ খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি পণ্য কেনা কমায়নি, কিন্তু বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ২০১৯ সালে পরিচালিত একটি বিশ্ব জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ডেটার ব্যবহার স্থিতিস্থাপক হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, যার কারণ হলো বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক প্যাকেজ এবং অফার।

