- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতিতে স্বল্পকালীন গড় ব্যয় রেখা বা SAC (Short-run Average Cost) রেখাটি কেন ‘U’ আকৃতির হয়, তা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও ব্যয়ের সম্পর্ককে তুলে ধরে। এই রেখাটি আমাদেরকে বোঝায় যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, যখন কিছু উৎপাদন উপকরণ স্থির থাকে এবং কিছু পরিবর্তনশীল, তখন প্রতি ইউনিট উৎপাদনের গড় খরচ কীভাবে পরিবর্তিত হয়। এই সম্পর্কটি বোঝা যেকোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি তাদের উৎপাদন পরিকল্পনা ও মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
১। স্থির ব্যয়: স্বল্পকালে একটি প্রতিষ্ঠানের কিছু ব্যয় স্থির থাকে, যা উৎপাদনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে না। যেমন, কারখানার ভাড়া, মেশিনের অবচয়, স্থায়ী কর্মচারীদের বেতন ইত্যাদি। যখন উৎপাদন কম হয়, তখন এই বিশাল স্থির ব্যয় অল্প কয়েকটি পণ্যের উপর ভাগ হয়ে যায়, ফলে প্রতিটি পণ্যের গড় স্থির ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু যখন উৎপাদন বাড়ানো হয়, তখন সেই স্থির ব্যয় অনেকগুলো পণ্যের উপর ভাগ হয়ে যায়, ফলে প্রতিটি পণ্যের গড় স্থির ব্যয় ক্রমাগত কমতে থাকে। এই কারণেই শুরুর দিকে গড় ব্যয়ের একটি বড় অংশ আসে স্থির ব্যয় থেকে, যা উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে।
২। পরিবর্তনশীল ব্যয়: পরিবর্তনশীল ব্যয় হলো সেই খরচ যা উৎপাদনের পরিমাণের সঙ্গে সরাসরি পরিবর্তিত হয়। যেমন কাঁচামালের খরচ, অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি। শুরুতে, যখন উৎপাদন কম থাকে, তখন পরিবর্তনশীল ব্যয়ের ওপর তেমন চাপ পড়ে না, তাই প্রতিটি ইউনিটের গড় পরিবর্তনশীল ব্যয়ও কম থাকে। কিন্তু যখন উৎপাদন একটি নির্দিষ্ট সীমার পর বাড়ানো হয়, তখন কাঁচামাল বা শ্রমের প্রয়োজন অতিরিক্ত বেড়ে যায়। অনেক সময় অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগের কারণে তাদের উৎপাদনশীলতা কমে আসে, ফলে প্রতি ইউনিট উৎপাদনের পরিবর্তনশীল ব্যয় বাড়তে থাকে, যা মোট গড় ব্যয়কেও বাড়িয়ে দেয়।
৩। উপাদানের কর্মদক্ষতা: শুরুর দিকে, যখন একটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করে, তখন তারা তাদের বিদ্যমান শ্রমিক ও মেশিনকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে, প্রতিটি অতিরিক্ত ইউনিট উৎপাদনের জন্য খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়, এবং উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন শ্রমিক দুটি মেশিনে কাজ করতে পারে, যা শুরুতে সম্ভব নাও হতে পারে। এই দক্ষতা বৃদ্ধি উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে গড় ব্যয় কমিয়ে দেয়। কিন্তু যখন একটি নির্দিষ্ট সীমার পরে অতিরিক্ত শ্রমিক ও উপকরণ যোগ করা হয়, তখন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় সাধন করা কঠিন হয়ে পড়ে, যা উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়।
৪। ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতা: স্বল্পকালীন সময়ে, একটি নির্দিষ্ট বিন্দু পর্যন্ত, উৎপাদন বাড়ানোর সাথে সাথে শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা (Marginal Productivity) বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো, শ্রমিকরা একত্রে কাজ করার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং দক্ষতার সঙ্গে উৎপাদন করতে পারে। এই ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতার কারণে প্রতিটি অতিরিক্ত ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় কম হয়। ফলে, গড় ব্যয় রেখা নিম্নমুখী হয়। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট স্তরের পর, উৎপাদনশীলতা কমতে শুরু করে কারণ স্থির উপাদান (যেমন কারখানা) সীমিত এবং অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগের কারণে কাজের পরিবেশ বা দক্ষতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
৫। ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনশীলতা: যখন একটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করে, তখন একসময় ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদনশীলতার সূত্রটি কার্যকর হয়। এর মানে হলো, অতিরিক্ত প্রতিটি শ্রমিকের থেকে যে পরিমাণ উৎপাদন পাওয়া যায়, তা আগের শ্রমিকের চেয়ে কম হয়। এর কারণ হলো, সীমিত স্থায়ী উপকরণের (যেমন কারখানা, মেশিন) ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়া। এর ফলে, প্রতিটি অতিরিক্ত ইউনিট উৎপাদনের জন্য পরিবর্তনশীল ব্যয় বেড়ে যায়। এই বর্ধিত ব্যয় গড় ব্যয়কে আবার উপরের দিকে ঠেলে দেয়, যার ফলে U আকৃতির রেখার দ্বিতীয় অংশটি উপরের দিকে উঠে যায়।
৬। সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনা: শুরুর দিকে যখন উৎপাদন কম থাকে, তখন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় করা সহজ হয়। প্রতিটি ইউনিটের খরচ কম থাকে, কারণ ব্যবস্থাপনার চাপ তেমন থাকে না। কিন্তু উৎপাদন যখন ব্যাপক পরিমাণে বাড়ানো হয়, তখন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় সাধনে অতিরিক্ত খরচ হয়। নতুন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, অতিরিক্ত উপকরণ সংগ্রহ এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনে যে ব্যয় হয়, তা গড় ব্যয়কে বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং প্রতি ইউনিটের গড় ব্যয় বাড়তে থাকে।
৭। আদর্শ উৎপাদন ক্ষমতা: প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি আদর্শ বা সর্বোত্তম উৎপাদন ক্ষমতা থাকে, যেখানে প্রতি ইউনিটের গড় ব্যয় সর্বনিম্ন হয়। এই বিন্দুর আগে, উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে গড় ব্যয় কমতে থাকে, কারণ স্থির ব্যয় ভাগ হয়ে যায় এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বিন্দুর পরে, অতিরিক্ত উৎপাদন শুরু করলে ব্যয় বাড়তে থাকে। কারণ এরপরে অতিরিক্ত উৎপাদন করার জন্য বাড়তি খরচ হয়, যেমন অতিরিক্ত সময়ের জন্য মজুরি, দ্রুত মেশিন ব্যবহার বা অতিরিক্ত কাঁচামাল সংগ্রহের খরচ, যা প্রতি ইউনিটের গড় ব্যয়কে বাড়িয়ে দেয়।
৮। শ্রমের বিভাজন: উৎপাদনের শুরুতে যখন মাত্র অল্প কিছু শ্রমিক নিয়োগ করা হয়, তখন তাদের মধ্যে কাজ সঠিকভাবে ভাগ করে দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে একজন শ্রমিককে একাধিক কাজ করতে হয়, যা তাদের দক্ষতা কমিয়ে দেয় এবং প্রতি ইউনিটের খরচ বাড়ায়। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমিক সংখ্যা বাড়লে, প্রতিটি শ্রমিককে একটি নির্দিষ্ট ও বিশেষ কাজে নিয়োজিত করা সম্ভব হয়। এতে তারা সেই নির্দিষ্ট কাজে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে, যা তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং প্রতি ইউনিটের গড় ব্যয় কমায়। এই কারণে গড় ব্যয় রেখা নিম্নমুখী হতে থাকে।
৯। কাঁচামালের ব্যবহার: যখন একটি প্রতিষ্ঠান অল্প পরিমাণে উৎপাদন করে, তখন কাঁচামাল বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ছোট ছোট পরিমাণে কিনতে হয়, যা অনেক সময় বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। এর ফলে প্রতি ইউনিটের কাঁচামাল খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু যখন উৎপাদন বেড়ে যায়, তখন বেশি পরিমাণে কাঁচামাল কেনার প্রয়োজন হয়। তখন পাইকারি হারে বা এক সাথে অনেক বেশি পরিমাণে কাঁচামাল কেনার সুযোগ তৈরি হয়, যা প্রতি ইউনিটের কাঁচামাল খরচ কমিয়ে দেয়। এই সুবিধা উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গড় ব্যয়কে নিচে নামিয়ে আনতে সাহায্য করে।
১০। অতিরিক্ত সময় ও ব্যয়: স্বল্পকালীন সময়ে উৎপাদনের পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট স্তরের পর বাড়াতে গেলে, অনেক সময় কর্মীদের অতিরিক্ত সময় কাজ করাতে হয়, যার জন্য স্বাভাবিক মজুরির চেয়ে বেশি হারে পারিশ্রমিক দিতে হয়। এতে করে শ্রমের খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া, রাত-দিন মেশিন চালু রাখলে তার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বা বিদ্যুতের খরচও বেড়ে যেতে পারে। এই অতিরিক্ত ব্যয়গুলো প্রতি ইউনিটের গড় ব্যয়কে আরও বাড়িয়ে দেয়, যা গড় ব্যয় রেখাকে আবার ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে।
উপসংহার: স্বল্পকালীন গড় ব্যয় রেখা কেন U আকৃতির হয়, তার প্রধান কারণ হলো স্থির ও পরিবর্তনশীল ব্যয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং উৎপাদনশীলতার পরিবর্তন। শুরুতে, উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে স্থির ব্যয় অনেকগুলো পণ্যের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় এবং উৎপাদনশীলতাও বাড়ে, ফলে গড় ব্যয় কমে যায়। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর পর, ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনশীলতার কারণে এবং অতিরিক্ত পরিবর্তনশীল ব্যয়ের কারণে প্রতিটি ইউনিটের উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে। এই দুটি বিপরীতমুখী প্রভাবের কারণেই গড় ব্যয় রেখা প্রথমে নিচে নামে এবং তারপর উপরে উঠে U আকৃতি ধারণ করে। এটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের একটি মৌলিক ধারণা যা প্রতিষ্ঠানকে সঠিক উৎপাদন স্তর নির্ধারণে সহায়তা করে।
U আকৃতির গড় ব্যয় রেখা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই ধারণাটি ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশকে নিও-ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির প্রবক্তাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। ১৮৯০-এর দশকে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল তার “Principles of Economics” গ্রন্থে স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন ব্যয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। পরবর্তীতে, ১৯২৪ সালে অ্যাডাম স্মিথের “An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations” গ্রন্থে শ্রম বিভাজনের ধারণাটি এই উৎপাদনশীলতার ধারণাটিকে আরও পরিষ্কার করে। একটি জরিপে দেখা যায়, ৭০% এরও বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে আদর্শ উৎপাদন ক্ষমতার কাছাকাছি কাজ করার চেষ্টা করে।

