- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: ১৮৩৪ সালের দারিদ্র আইন সংস্কার ছিল যুক্তরাজ্যের সামাজিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি আগের আইনগুলোর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে দরিদ্রদের সহায়তা প্রদানের একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করে, যা সমাজের দরিদ্রদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনে এবং আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
১। কঠোর কর্মশালা ব্যবস্থা: এই সংস্কারের মাধ্যমে কর্মশালা ব্যবস্থা চালু করা হয়। দরিদ্রদের সাহায্য পাওয়ার জন্য এই কর্মশালাগুলোতে কাজ করতে হতো। এর ফলে বেকার ও অলস ব্যক্তিরা যেন বিনা পরিশ্রমে সরকারি সাহায্য না পায়, তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। কর্মশালায় কঠোর পরিশ্রমের পরিবেশ তৈরি করা হয় যাতে শুধুমাত্র প্রকৃত অভাবী মানুষরাই সাহায্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়। এই ব্যবস্থা দরিদ্রদের কর্মঠ করে তুলতে এবং তাদের স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করত। এটি ছিল পূর্ববর্তী ব্যবস্থার তুলনায় একটি বড় পরিবর্তন, যেখানে স্থানীয় গির্জা বা প্যারিশ থেকে সরাসরি আর্থিক সাহায্য দেওয়া হতো।
২। স্বনির্ভরতার ধারণা: এই আইনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল দরিদ্রদের মধ্যে স্বনির্ভরতার ধারণা তৈরি করা। কর্মশালায় কাজ করে তারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে শিখত। এর ফলে, সমাজের বোঝা না হয়ে তারা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারতো। এটি সমাজে একটি নতুন নৈতিকতার জন্ম দেয়, যেখানে কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। এর মাধ্যমে সরকার দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্র সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল, কেবল সাময়িক সাহায্য দিয়ে নয়, বরং মানুষকে তাদের নিজস্ব পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়ে।
৩। স্থানীয় প্রশাসনের বিলুপ্তি: ১৮৩৪ সালের আইনটি বিভিন্ন স্থানীয় প্যারিশের আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটায়। এর পরিবর্তে, বেশ কয়েকটি প্যারিশকে একত্রিত করে ইউনিয়ন তৈরি করা হয়। এই ইউনিয়নগুলো একটি একক বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হতো, যা সমগ্র এলাকার দারিদ্র আইন কার্যকর করত। এই কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থার ফলে দারিদ্র সহায়তা প্রদানে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এর আগে প্রতিটি প্যারিশের নিজস্ব নিয়ম-কানুন থাকায় দুর্নীতি ও অসামঞ্জস্যতা দেখা যেত, যা নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব হয়।
৪। আর্থিক সাশ্রয়: এই সংস্কারের ফলে সরকারের আর্থিক সাশ্রয় হয়। কর্মশালার কঠোর নিয়ম এবং সাহায্য প্রদানের শর্তাবলী এতটাই কঠিন ছিল যে অনেকেই স্বেচ্ছায় সাহায্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এর ফলে সাহায্যপ্রার্থী মানুষের সংখ্যা কমে যায় এবং সরকারের ব্যয় হ্রাস পায়। এর আগে দরিদ্রদের সরাসরি আর্থিক সহায়তা দিতে গিয়ে সরকারের প্রচুর অর্থ খরচ হতো। ১৮৩৪ সালের আইনটি এই খরচকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়, যা তৎকালীন ব্রিটিশ অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক ছিল।
৫। ইউনিয়ন গঠনের গুরুত্ব: নতুন ইউনিয়ন গঠনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। একাধিক প্যারিশকে একত্রিত করে একটি বড় প্রশাসনিক ইউনিট তৈরি করা হয়। প্রতিটি ইউনিয়নের নিজস্ব কর্মশালা ছিল, যেখানে দরিদ্রদের আশ্রয় এবং কাজ দেওয়া হতো। এই ব্যবস্থা স্থানীয় প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল করে তোলে। ইউনিয়নের বোর্ডগুলো স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হতো এবং তারা কর্মশালা পরিচালনা এবং সাহায্য প্রদানের নীতি নির্ধারণ করত। এটি স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকারিতাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়।
৬। সাহায্যের ধরন পরিবর্তন: এই আইনের মাধ্যমে সাহায্যের ধরন পরিবর্তন করা হয়। আর্থিক সাহায্যের পরিবর্তে, দরিদ্রদের কর্মশালায় থাকার এবং কাজ করার সুযোগ দেওয়া হতো। এটি ‘আউটডোর রিলিফ’ বা বাড়ির বাইরে থেকে আর্থিক সাহায্য প্রদানের প্রচলিত প্রথাকে বাতিল করে দেয়। এই নতুন ব্যবস্থাটি দরিদ্রদের জন্য একটি কঠিন বিকল্প ছিল, যা কেবল তাদেরকেই উৎসাহিত করত যারা সত্যিই চরম দারিদ্র্যের শিকার। এই নীতিটি দরিদ্রদের কর্মস্পৃহা এবং আত্মসম্মানবোধ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
৭। স্বেচ্ছাসেবী নীতির সমাপ্তি: ১৮৩৪ সালের আইনটি স্বেচ্ছাসেবী নীতির সমাপ্তি ঘটায়। আগের আইনগুলোতে দরিদ্রদের সাহায্য প্রদান অনেকটা স্বেচ্ছামূলক এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু নতুন আইনে এটি একটি সুসংগঠিত এবং কঠোর নীতিতে পরিণত হয়। দরিদ্রদের জন্য সাহায্য গ্রহণ একটি অধিকার না হয়ে বরং একটি শর্তসাপেক্ষ সুবিধা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সাহায্য প্রদান প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট কাঠামো এবং মান তৈরি হয়।
৮। সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা: এই আইনটি সমাজে সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। কর্মশালার কঠোর নিয়ম এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাত্রা দরিদ্রদের মধ্যে দায়িত্ববোধ এবং নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলে। এতে সমাজের বিশৃঙ্খলা হ্রাস পায়। যেসব মানুষ কাজ করতে অনিচ্ছুক ছিল, তারা এই কঠিন পরিবেশ এড়াতে কাজ খুঁজতে শুরু করে। এটি সমাজের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৯। দারিদ্র্যের কারণ নির্ণয়: নতুন আইনটি দারিদ্র্যের কারণ নির্ণয় করার চেষ্টা করে। এই আইনটি দরিদ্রদের দুটি ভাগে ভাগ করে: ‘অক্ষম দরিদ্র’ (যেমন অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু) এবং ‘সক্ষম দরিদ্র’ (যারা কাজ করতে সক্ষম)। সক্ষম দরিদ্রদের জন্য কর্মশালা বাধ্যতামূলক করা হয়, আর অক্ষমদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই বিভাজনটি দারিদ্র্য সমস্যার একটি কাঠামোগত সমাধানের দিকে ইঙ্গিত করে। এটি ছিল সমস্যাকে মূল থেকে বোঝার এবং সমাধান করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
১০। নীতিগত পরিবর্তন: এই সংস্কারের মাধ্যমে নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলে। এটি কেবল দরিদ্রদের সাহায্য প্রদানের একটি কৌশল ছিল না, বরং দারিদ্র্যের প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটায়। এটি রাষ্ট্রকে দরিদ্রদের প্রতি কঠোর নীতি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। এই নীতিটি পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সমাজে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের ধারণাকে প্রভাবিত করে, যেখানে সাহায্য কেবল প্রয়োজন অনুযায়ী দেওয়া হয়, অধিকার হিসেবে নয়।
১১। শিশুদের কর্মসংস্থান: কর্মশালার ভেতরে শিশুদের কর্মসংস্থান করা হতো। শিশুদের জন্যও কঠোর নিয়ম ছিল এবং তাদেরও কাজ করতে হতো। যদিও এই ব্যবস্থা পরবর্তীকালে সমালোচিত হয়, তবে তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এটি শিশুদের কর্মঠ করে তোলার একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হতো। এর মাধ্যমে শিশুরা ছোট থেকেই শ্রমের গুরুত্ব শিখত।
১২। পরিবারের বিচ্ছিন্নতা: কর্মশালায় পরিবারের বিচ্ছিন্নতা ঘটানো হতো। পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের আলাদা আলাদাভাবে রাখা হতো, যাতে তারা একে অপরের উপর নির্ভরশীল না হয় এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে। এই নীতিটি পরিবার প্রথার উপর একটি বড় আঘাত ছিল, কিন্তু আইন প্রণেতারা মনে করতেন এটি দরিদ্রদের স্বাবলম্বী করার জন্য জরুরি। এই বিচ্ছিন্নতা ছিল কর্মশালার একটি অত্যন্ত বিতর্কিত দিক।
১৩। কর্মশালার ভয়: কর্মশালাগুলোর কঠোর পরিবেশ এবং শর্তের কারণে সাধারণ মানুষের মনে কর্মশালার ভয় তৈরি হয়। এই ভয়টি অনেককে কর্মসংস্থান খুঁজতে এবং স্বনির্ভর হতে উৎসাহিত করে। কর্মশালায় আশ্রয় নেওয়াকে সমাজের চোখে একটি লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে দেখা হতো। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপটি দরিদ্রদের নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করে।
১৪। বেকারত্ব হ্রাস: এই আইন বেকারত্ব হ্রাস করতে সাহায্য করে। কর্মশালায় যাওয়ার ভয়ে অনেকেই কাজ খুঁজতে শুরু করে। এই ব্যবস্থাটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল যে বিনা পরিশ্রমে জীবন ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়, যা শেষ পর্যন্ত কর্মসংস্থান বাড়াতে সাহায্য করে। এর ফলে অলসতা এবং সমাজের উপর নির্ভরশীলতা কমে যায়।
১৫। শ্রমবাজারের উপর প্রভাব: ১৮৩৪ সালের আইনটির শ্রমবাজারের উপর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। কর্মশালার কঠোর নিয়ম এবং কম মজুরি শ্রমিকদের কাজের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে। এর ফলে বাজারে শ্রমিকের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, যা শিল্প বিপ্লবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যাওয়ায় শিল্প মালিকরা লাভবান হন।
১৬। নতুন সামাজিক কাঠামো: এই সংস্কার একটি নতুন সামাজিক কাঠামো তৈরি করে। এটি দরিদ্রদেরকে সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশে সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং তাদের জীবনযাত্রার মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এই কাঠামোটি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভাজন তৈরি করে এবং দরিদ্রদের জন্য একটি নির্দিষ্ট জীবনধারা চাপিয়ে দেয়।
১৭। জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ: এই কঠোর আইনের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ দেখা যায়। বিশেষত উত্তর ইংল্যান্ডে এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হয়, যেখানে শিল্প শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। অনেক স্থানে কর্মশালা ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এই প্রতিরোধ সত্ত্বেও আইনটি কার্যকর ছিল, যদিও পরবর্তীকালে কিছু সংশোধন করা হয়।
উপসংহার: ১৮৩৪ সালের দারিদ্র আইন সংস্কার ছিল একটি বিতর্কিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন। এটি দরিদ্রদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন আনে এবং আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে। যদিও এর কঠোর নিয়ম এবং মানবিক দিক নিয়ে সমালোচনা রয়েছে, তবে এটি যুক্তরাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, যা দারিদ্র্য মোকাবেলায় একটি কাঠামোগত ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতির জন্ম দেয়।
🎨 কঠোর কর্মশালা ব্যবস্থা 🛠️ স্বনির্ভরতার ধারণা 🚫 স্থানীয় প্রশাসনের বিলুপ্তি 💰 আর্থিক সাশ্রয় 🤝 ইউনিয়ন গঠনের গুরুত্ব 🔄 সাহায্যের ধরন পরিবর্তন 🔚 স্বেচ্ছাসেবী নীতির সমাপ্তি 👮 সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা 🕵️ দারিদ্র্যের কারণ নির্ণয় 📜 নীতিগত পরিবর্তন 👧 শিশুদের কর্মসংস্থান 💔 পরিবারের বিচ্ছিন্নতা 😨 কর্মশালার ভয় 📉 বেকারত্ব হ্রাস 💼 শ্রমবাজারের উপর প্রভাব 🏗️ নতুন সামাজিক কাঠামো ✊ জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ।
১৮৩৪ সালের দারিদ্র আইন সংস্কারটি ‘রয়াল কমিশন অন দ্য পুওর ল’ (১৮৩২) এর সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত হয়। এই কমিশনটি তৎকালীন দারিদ্র আইনগুলোর দুর্বলতা এবং অপব্যবহার নিয়ে একটি ব্যাপক জরিপ পরিচালনা করে। কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুরানো ব্যবস্থায় (যেমন ‘স্পিনহ্যামল্যান্ড সিস্টেম’, ১৭৯৫) দরিদ্রদের মজুরি পূরণের জন্য প্যারিশ থেকে সরাসরি আর্থিক সাহায্য দেওয়া হতো, যা শ্রমিকদের অলস করে তুলছিল এবং মজুরি কমিয়ে দিচ্ছিল। নতুন আইনটি ১৮৩৪ সালের ১৪ই আগস্ট কার্যকর হয় এবং এর ফলে প্রায় ১৫,০০০ স্থানীয় প্যারিশকে ৬০০টিরও বেশি ইউনিয়নে বিভক্ত করা হয়। ১৮৪৩ সাল নাগাদ প্রায় ৯৩% প্যারিশ নতুন আইনের আওতায় আসে। এই আইনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ‘ইনডোর রিলিফ’ (কর্মশালার ভেতরে সাহায্য) চালু করা এবং ‘আউটডোর রিলিফ’ (বাইরে থেকে আর্থিক সাহায্য) সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা, যা সরকারের খরচ কমিয়ে দেয় এবং সমাজে শ্রমের গুরুত্ব বৃদ্ধি করে।

