- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা: জনসংখ্যাস্ফীতি মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক পুরোনো এবং জটিল সমস্যা। এটি কেবল একটি সংখ্যাগত বৃদ্ধি নয়, বরং সমাজ, অর্থনীতি এবং পরিবেশের ওপর এর গভীর প্রভাব রয়েছে। এই বৃদ্ধি যখন দেশের প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের তুলনায় দ্রুতগতিতে ঘটে, তখন তা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দেয়। জনসংখ্যাস্ফীতি তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের সমস্যা নয়, বরং এটি একটি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ যা মানবজাতির সামগ্রিক সুস্থিরতাকে প্রভাবিত করে।
শাব্দিক অর্থ: জনসংখ্যাস্ফীতি শব্দটি দুটি ভিন্ন শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘জনসংখ্যা’ যার অর্থ হল কোনো নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের মোট সংখ্যা এবং ‘স্ফীতি’ যার অর্থ হল অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা ফুলে ওঠা। সুতরাং, শাব্দিক অর্থে জনসংখ্যাস্ফীতি বলতে বোঝায় কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে জনসংখ্যার অনিয়ন্ত্রিত বা অতিরিক্ত বৃদ্ধি।
জনসংখ্যাস্ফীতি হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে কোনো দেশের বা অঞ্চলের জনসংখ্যা সেখানকার সম্পদ, কর্মসংস্থান, খাদ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতাকে অতিক্রম করে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলে। এর ফলে সমাজে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অপুষ্টি, পরিবেশ দূষণ এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি পায়। মূলত, যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জন্মহারের কারণে মৃত্যুহারের চেয়ে অনেক বেশি হয়, তখন জনসংখ্যাস্ফীতি ঘটে। এটি শুধুমাত্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয় নয়, বরং এর সাথে জড়িত সম্পদের বণ্টন, আর্থ-সামাজিক সমতা এবং উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো।
১. অগবার্ন ও নিমকফ (Ogburn and Nimkoff): তাদের মতে, “জনসংখ্যাস্ফীতি বলতে সাধারণত জনসংখ্যা এবং সম্পদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতাকে বোঝায়, যেখানে জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায় এবং সম্পদ তুলনামূলকভাবে কম থাকে।” (Population explosion generally refers to the imbalance between population and resources, where population increases at a rapid rate while resources remain comparatively scarce.)
২. কার্ল মার্কস (Karl Marx): কার্ল মার্কস জনসংখ্যাস্ফীতিকে পুঁজিবাদের ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক অসমতা ও বেকারত্বের সাথে সম্পর্কিত করে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁর মতে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমের অতিরিক্ত সরবরাহ তৈরি হয়, যা জনসংখ্যাস্ফীতির একটি লক্ষণ। (Karl Marx defined population explosion as an economic inequality and unemployment resulting from capitalism. According to him, the capitalist system creates an excess supply of labor, which is a symptom of population explosion.)
৩. থমাস রবার্ট ম্যালথাস (Thomas Robert Malthus): যদিও তাঁর নাম উপরে উল্লেখিত তালিকায় নেই, জনসংখ্যা বিষয়ে তাঁর ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ম্যালথাসের মতে, “জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়, কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে; ফলে জনসংখ্যাস্ফীতি খাদ্য সংকটের জন্ম দেয়।” (Population increases geometrically, while food production increases arithmetically; as a result, a population explosion gives rise to a food crisis.)
৪. স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন (Samuel P. Huntington): তিনি জনসংখ্যাস্ফীতিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সাথে সম্পর্কিত করেছেন। তাঁর মতে, “জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নতুন প্রজন্মের চাহিদা ও প্রত্যাশা বৃদ্ধি পায়, যা অনেক সময় রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায় এবং অস্থিতিশীলতার কারণ হয়।” (He related population explosion to social and political instability. According to him, population growth increases the needs and expectations of the new generation, which often exceeds the state’s capacity and causes instability.)
৫. অক্সফোর্ড ডিকশনারি (Oxford Dictionary): অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, “জনসংখ্যাস্ফীতি হলো জনসংখ্যার আকস্মিক এবং বড় আকারের বৃদ্ধি, বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা সময়ে।” (A sudden and great increase in the population of a particular place or area.)
৬. ডিমক ও ডিমক (Dimock and Dimock): তাদের মতে, “জনসংখ্যাস্ফীতি হলো এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে জনসংখ্যা এতো দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে তা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়।” (Population explosion is a situation where population increases so rapidly that it fails to keep pace with the socio-economic development of the country.)
৭. এল.ডি. হোয়াইট (L.D. White): তিনি জনসংখ্যাস্ফীতিকে একটি প্রশাসনিক সমস্যা হিসেবে দেখেছেন। তার মতে, “জনসংখ্যাস্ফীতি দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও সরকারি সেবার উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে প্রশাসনিক দক্ষতা হ্রাস পায়।” (He viewed population explosion as an administrative problem. According to him, “population explosion puts immense pressure on the country’s administrative structure and public services, which reduces administrative efficiency.”)
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর সারসংক্ষেপ করলে বলা যায়, জনসংখ্যাস্ফীতি হলো একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থা যেখানে কোনো অঞ্চলের জনসংখ্যা তার প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যায়। এটি এমন এক সংকটময় পরিস্থিতি, যা দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের মতো গুরুতর সমস্যা তৈরি করে।
উপসংহার: জনসংখ্যাস্ফীতি শুধুমাত্র একটি সংখ্যাগত বৃদ্ধি নয়, বরং এটি একটি উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। এটি খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কার্যকর পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের জন্য জনসংখ্যাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা যা সরকার, ব্যক্তি এবং সমাজের সকল স্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সফল হতে পারে।
জনসংখ্যাস্ফীতি হলো প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের তুলনায় জনসংখ্যার দ্রুত ও ভারসাম্যহীন বৃদ্ধি।
বিশ্বের জনসংখ্যা ১৯৫০ সালে মাত্র ২.৫ বিলিয়ন ছিল, যা ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৯.৭ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হয়। ২০১৯ সালের জাতিসংঘ জনসংখ্যা জরিপ অনুযায়ী, ভারত ২০২৭ সালের মধ্যে চীনকে অতিক্রম করে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হবে। এই দ্রুত বৃদ্ধি সীমিত সম্পদ, কর্মসংস্থান ও খাদ্য সরবরাহের উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।