- readaim.com
- 0


উত্তর::ভূমিকা: উপস্থাপনা অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো বাজার। এটি চাহিদা ও সরবরাহের পারস্পরিক ক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। তবে, এই ব্যবস্থা সবসময় পুরোপুরি কার্যকর হয় না। যখন কোনো কারণে বাজার তার স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে বাজার ব্যর্থতা বা Market Failure বলা হয়। এই ব্যর্থতা সামাজিক কল্যাণ হ্রাস করে এবং সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে।
১। বাহ্যিকতা: অর্থনীতির আলোচনায় বাহ্যিকতা বলতে এমন প্রভাবকে বোঝানো হয়, যা কোনো উৎপাদন বা ভোগের কার্যক্রমের ফলে তৃতীয় কোনো পক্ষকে প্রভাবিত করে, অথচ সেই পক্ষ তার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না বা কোনো মূল্য প্রদান করে না। এটি দুই প্রকারের হতে পারে: নেতিবাচক এবং ইতিবাচক। যেমন, একটি কারখানার ধোঁয়া বায়ু দূষণ ঘটিয়ে আশেপাশের মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, যা একটি নেতিবাচক বাহ্যিকতা। এর ফলে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ কমে যায়। এর বিপরীতে, কোনো ব্যক্তি যদি তার বাড়ির সামনে একটি সুন্দর বাগান তৈরি করে, তাহলে আশেপাশের মানুষও তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে, যা একটি ইতিবাচক বাহ্যিকতা।
২। তথ্যের অসামঞ্জস্যতা: তথ্যের অসামঞ্জস্যতা হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে বাজারের দুটি পক্ষের মধ্যে এক পক্ষ অন্য পক্ষের চেয়ে বেশি তথ্য রাখে। এই ধরনের অসম্পূর্ণ তথ্য অনেক সময় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যবহৃত গাড়ির বিক্রেতা গাড়ির ত্রুটি সম্পর্কে ক্রেতার চেয়ে বেশি জানে। এই তথ্যের অভাবে ক্রেতা একটি ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির জন্য বেশি মূল্য দিতে পারে, যা বাজারের স্বাভাবিক লেনদেনকে ব্যাহত করে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, কম তথ্যের অধিকারী পক্ষ প্রায়শই ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
৩। অপ্রতিযোগী বাজার: একটি অপ্রতিযোগী বাজার বা Imperfect Competition হলো সেই বাজার ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিযোগিতা সীমিত বা অনুপস্থিত থাকে। এটি সাধারণত একচেটিয়া বা অল্প বিক্রেতার বাজারে (অলিগোপলি) দেখা যায়। এই ধরনের বাজারে বিক্রেতারা পণ্যের দাম ও সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এবং উচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পারে। ফলস্বরূপ, তারা কম উৎপাদন করতে পারে এবং উচ্চ মূল্য ধার্য করতে পারে, যা ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর। এটি পণ্যের মান ও নতুনত্বের ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করে, যা সমাজের জন্য একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা।
৪। গণদ্রব্য: গণদ্রব্য বা Public Goods বলতে এমন পণ্য বা সেবাকে বোঝায়, যা একযোগে একাধিক ব্যক্তি উপভোগ করতে পারে এবং কাউকে এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা যায় না। যেমন, সড়ক বাতি বা জাতীয় প্রতিরক্ষা। এই পণ্যগুলো সাধারণত বেসরকারি খাত সরবরাহ করতে উৎসাহিত হয় না, কারণ তারা এর জন্য কোনো মূল্য আদায় করতে পারে না। ফলে, এসব পণ্যের সরবরাহ কম হয়। এর কারণ হলো, একজন ব্যক্তি এর জন্য মূল্য না দিয়েও এর সুবিধা ভোগ করতে পারে, যা ‘ফ্রি-রাইডার’ সমস্যা নামে পরিচিত।
৫। অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা: বাজারের স্বাভাবিক কার্যকারিতা হলো চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। কিন্তু যখন এটি ব্যাহত হয়, তখন অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, শ্রমবাজারে যদি শ্রমের সরবরাহ বেশি থাকে কিন্তু চাহিদা কম হয়, তাহলে বেকারত্ব সৃষ্টি হয়। আবার, মুদ্রাস্ফীতিও এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা, যা অতিরিক্ত অর্থের প্রবাহের কারণে সৃষ্টি হয়। এই ধরনের ভারসাম্যহীনতা সম্পদ বণ্টন ও সামাজিক কল্যাণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং বাজারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে।
৬। সম্পদ বণ্টনের অসমতা: বাজার ব্যবস্থার একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো এটি সম্পদ বণ্টনে অসমতা সৃষ্টি করতে পারে। বাজার প্রতিযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে সফলদের আরও সম্পদশালী করে তোলে, আর যারা পিছিয়ে পড়ে, তারা আরও দরিদ্র হয়। এর ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যায়। এই অসমতা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এটি নৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যা বাজারের ত্রুটি হিসেবে বিবেচিত হয়।
৭। বাজারের অদক্ষতা: বাজারের অদক্ষতা বলতে বোঝায় যখন সম্পদ সর্বোত্তমভাবে ব্যবহৃত হয় না। এর ফলে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ হ্রাস পায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো উৎপাদনে ক্ষতিকর বর্জ্য তৈরি হয়, যা পরিবেশের ক্ষতি করে, তবে তার জন্য উৎপাদনকারীকে কোনো খরচ দিতে হয় না। এর ফলে সেই উৎপাদনকারী কম খরচে পণ্য তৈরি করে, কিন্তু সমাজের ওপর সেই বর্জ্যের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই ধরনের অদক্ষতা সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়।
৮। স্থিতিশীলতার অভাব: বাজারের স্বাভাবিক কার্যকারিতার জন্য একটি স্থিতিশীল পরিবেশ অপরিহার্য। তবে, বাজার ব্যবস্থায় প্রায়শই স্থিতিশীলতার অভাব দেখা যায়। এটি সাধারণত অর্থনৈতিক চক্রের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যেখানে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হয়, তারপর মন্দা বা সংকট আসে। এই অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয় এবং বেকারত্ব বাড়িয়ে দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য ক্ষতিকর। বাজারের এই অস্থিরতা সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হতে পারে।
উপসংহার: বাজারের কার্যকারিতা সত্ত্বেও এর মধ্যে থাকা এই ব্যর্থতাগুলো সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এই সীমাবদ্ধতাগুলো মোকাবেলা করতে সরকার বিভিন্ন নীতি ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। একটি সুষম ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থার পাশাপাশি সরকারি হস্তক্ষেপ বা সহায়ক নীতিগুলো অপরিহার্য। এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, বরং সামাজিক ন্যায় ও সমতা নিশ্চিত করতেও সাহায্য করে।
- বাহ্যিকতা
- তথ্যের অসামঞ্জস্যতা
- অপ্রতিযোগী বাজার
- গণদ্রব্য
- অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা
- সম্পদ বণ্টনের অসমতা
- বাজারের অদক্ষতা
- স্থিতিশীলতার অভাব
১৯২০-এর দশকে ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ এবং ১৯২৯ সালের মহামন্দা বাজারের চরম ব্যর্থতার ঐতিহাসিক উদাহরণ। এরপর থেকে, সরকারগুলো আর্থিক বাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন নিয়ম প্রণয়ন করে। ২০০০ সালের ডট-কম বুদবুদ এবং ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটও বাজারের অতিরিক্ত স্বাধীনতা এবং তথ্যের অসামঞ্জস্যতার কুফল দেখায়। এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বাজারের ওপর যথাযথ নজরদারি না থাকলে তা ভয়াবহ সংকট ডেকে আনতে পারে।