- readaim.com
- 0
উত্তর।।প্রস্তাবনা: মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিটি মানুষের জন্য অপরিহার্য, যা ছাড়া একটি সম্মানজনক ও পূর্ণাঙ্গ জীবন কল্পনা করা কঠিন। এগুলো এমন কিছু অধিকার যা রাষ্ট্রের সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত থাকে এবং কোনো সরকার বা ব্যক্তি চাইলেই তা হরণ করতে পারে না। এই অধিকারগুলো ব্যক্তি স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে, একটি সভ্য সমাজে প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে। এ কারণেই মৌলিক অধিকারগুলো যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
শাব্দিক অর্থ
মৌলিক অধিকার শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো মানুষের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য ও ভিত্তিগত কিছু সুযোগ-সুবিধা বা ক্ষমতা, যা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সুরক্ষিত। ‘মৌলিক’ বলতে বোঝায় যা অত্যাবশ্যক বা অপরিহার্য, আর ‘অধিকার’ বলতে বোঝায় কোনো কিছু দাবি করার বৈধ ক্ষমতা।
পারিভাসিক অর্থ:
মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) হলো সেইসব অধিকার যা একটি দেশের সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত করা হয় এবং রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই অধিকারগুলো রক্ষায় বাধ্য থাকে। এগুলো সাধারণত ব্যক্তির স্বাধীনতা, সমতা, নিরাপত্তা ও সম্পত্তির অধিকারের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে। এই অধিকারগুলো সাধারণ আইন দ্বারা পরিবর্তন করা যায় না, বরং সংবিধান সংশোধনের মতো কঠোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা করতে হয়। মৌলিক অধিকারের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে নাগরিকদের জীবন ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।
সাধারণ ভাষায় আমরা মৌলিক অধিকারকে আমাদের জন্মগত অধিকার হিসেবে দেখি, যা আমাদের ভালো ও সম্মানজনক জীবন যাপনের জন্য একান্ত প্রয়োজন। আমরা মনে করি, এই অধিকারগুলো সুরক্ষিত না থাকলে আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারব না, নিজেদের পছন্দমতো কাজ করতে পারব না বা সমাজে সমানভাবে বাঁচতে পারব না। মৌলিক অধিকার আমাদের সুরক্ষা দেয় যাতে সরকার বা কোনো শক্তিশালী ব্যক্তি আমাদের উপর অন্যায়ভাবে ক্ষমতা খাটাতে না পারে। এটি এমন একটি ঢাল যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা এনে দেয়।
এখানে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে প্রদত্ত কিছু সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:-
১. অধ্যাপক ড. ফখরুল ইসলাম: “মৌলিক অধিকার হলো সেইসব নাগরিক অধিকার যা সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত এবং যা ছাড়া ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে না।” (Fundamental rights are those civil rights protected by the constitution, without which an individual cannot fully develop their personality.)
২। ড. কামাল হোসেন: “মৌলিক অধিকার সংবিধানের সেই অংশ যা নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করে এবং রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখে।” (Fundamental rights are that part of the constitution which ensures the liberty and dignity of citizens and keeps the state within specified limits.)
৩। অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ: “মৌলিক অধিকার এমন কিছু বিধিবদ্ধ অধিকার যা রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ্চ আইন দ্বারা সুরক্ষিত এবং যা সাধারণ আইনের ঊর্ধ্বে স্থান পায়।” (Fundamental rights are codified rights protected by the supreme law of the state and hold precedence over ordinary laws.)
৪। ড. আতিউর রহমান: “মৌলিক অধিকার হলো মানুষের সহজাত অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, যা ব্যক্তির সামগ্রিক কল্যাণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য।” (Fundamental rights are the constitutional recognition of inherent human rights, essential for an individual’s overall well-being and the establishment of social justice.)
৫। অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: “মৌলিক অধিকার হলো সেই আইনি সুরক্ষা যা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রদান করে, যাতে তারা ভয় বা পক্ষপাতিত্ব ছাড়া তাদের জীবন যাপন করতে পারে।” (Fundamental rights are legal protections provided by the state to its citizens, so that they can live their lives without fear or bias.)
৬। ড. রফিকুল ইসলাম: “মৌলিক অধিকার হলো ব্যক্তির অপরিহার্য দাবি যা রাষ্ট্রকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে এবং যা নাগরিকের সম্মান ও স্বাধীনতার মূল ভিত্তি।” (Fundamental rights are essential claims of an individual that the state must fulfill, serving as the core foundation for a citizen’s dignity and freedom.)
৭।অধ্যাপক আনিসুজ্জামান: “মৌলিক অধিকার বলতে সেইসব মানবিক অধিকারকে বোঝায় যা সাংবিধানিক নিশ্চয়তা লাভ করে এবং যার লঙ্ঘন গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।” (Fundamental rights refer to those human rights that receive constitutional guarantee and whose violation is considered a serious offense.)
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলির আলোকে আমরা মৌলিক অধিকারকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি যে, মৌলিক অধিকার হলো সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সুরক্ষিত সেইসব অপরিহার্য মানবীয় দাবি ও স্বাধীনতা, যা প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ, মর্যাদা রক্ষা এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। এই অধিকারগুলো রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে এবং কোনো সাধারণ আইন দ্বারা এটি খর্ব করা যায় না, বরং এর লঙ্ঘন গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
সামাপিকা: মৌলিক অধিকারগুলো একটি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এই অধিকারগুলো নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সুরক্ষা এবং সমাজে সমানাধিকার নিশ্চিত করে, যা একটি সভ্য ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। যদিও এই অধিকারগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক সুরক্ষিত, তবুও এর কার্যকর প্রয়োগ এবং প্রতিটি নাগরিকের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। মৌলিক অধিকারগুলো কেবল আইনি বিধান নয়, বরং এটি মানব মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীক, যা একটি জাতির অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ উন্মোচন করে।
মৌলিক অধিকার হলো সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত মানুষের অপরিহার্য জীবনধারণের অধিকার।
বিশ্বব্যাপী মৌলিক অধিকারের ধারণা বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আন্দোলনের মাধ্যমে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের “ম্যানিফেস্টো অব দ্য রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড সিটিজেন” এবং ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের “সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা” (Universal Declaration of Human Rights) মৌলিক অধিকারের ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে তৃতীয় ভাগে ২৬ থেকে ৪৭ক অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারসমূহ বর্ণিত আছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য ১৯টি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে সামরিক শাসনকালে, এই অধিকারগুলো খর্ব করার চেষ্টা হয়েছে, তবে আদালত সবসময়ই এই অধিকারগুলো রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মৌলিক অধিকারগুলো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য একটি সুরক্ষা কবচ।

