- readaim.com
- 0

ভূমিকা।।প্রকাকথা:- অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি হলো গবেষণার একটি গুণগত পদ্ধতি, যেখানে গবেষক সরাসরি কোনো সমাজ বা গোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করে তাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন। এটি সামাজিক বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে গভীর ও বাস্তবসম্মত তথ্য সংগ্রহ করা যায়, তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। নিচে অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের সুবিধাসমূহ:-
১.গভীর ও বাস্তবসম্মত তথ্য সংগ্রহ:- এই পদ্ধতিতে গবেষক সরাসরি গবেষণার ক্ষেত্রে নিমজ্জিত হয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন, ফলে প্রাপ্ত তথ্য অত্যন্ত গভীর ও বাস্তবসম্মত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২০-এর দশকে ব্রনিসław মালিনowski তার গবেষণায় মেলানেশিয়ান দ্বীপবাসীদের জীবনধারা বুঝতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন।
২.সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঠিক বোঝাপড়া:- অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গবেষক স্থানীয় ভাষা, রীতিনীতি ও বিশ্বাস সরাসরি উপলব্ধি করতে পারেন। ১৯৬০-এর দশকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষকরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের আচরণের পেছনের কারণগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন।
৩.আচরণগত স্বচ্ছতা:- যেহেতু গবেষক দীর্ঘদিন ধরে সমাজের মধ্যে অবস্থান করেন, তাই লোকেরা স্বাভাবিক আচরণ করে। ২০০৫ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত তথ্য অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় ৪০% বেশি নির্ভরযোগ্য।
৪.গবেষক-বিষয়ের মধ্যে আস্থা তৈরি:- গবেষক যখন দীর্ঘদিন কোনো গোষ্ঠীর সাথে থাকেন, তখন তাদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ফলে তথ্য সংগ্রহ সহজ হয়। ১৯৮০-এর দশকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীদের ৭৫% বেশি সত্যিকারের তথ্য দেয়।
৫.গুণগত তথ্যের সমৃদ্ধি:- এই পদ্ধতিতে সংখ্যাগত তথ্যের চেয়ে গুণগত তথ্য বেশি সংগ্রহ করা যায়, যা সামাজিক গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১০ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৬০% নৃবিজ্ঞানী এই পদ্ধতিকে সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করেন।
৬.গোপন আচরণ ও অভ্যাসের সন্ধান:- এই পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষক সমাজের গোপন আচরণ, রীতিনীতি ও অভ্যাস সম্পর্কে জানতে পারেন, যা সাধারণত প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে প্রকাশ পায় না। যেমন, ২০১৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতের কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান গোপন রাখে, কিন্তু অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তা উন্মোচিত হয়েছে।
৭.পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া:- গবেষক দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার ক্ষেত্রে অবস্থান করার ফলে পরিবর্তনশীল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে পারেন। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ৩৫% বেশি কার্যকর সমাধান পাওয়া গেছে।
৮.অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি সরাসরি বোঝা:- এই পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত মতামত, বিশ্বাস ও অনুভূতি সরাসরি জানা যায়। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ ৫০% বেশি কার্যকর ছিল।
৯.গবেষণার ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি:- যেহেতু গবেষক সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকেন, তাই প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি। ২০২১ সালের একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে সংগৃহীত তথ্যের বৈধতা ৭০% বেশি।
১.সময় ও অর্থের অপচয়:- এই পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করতে হয়, যা অনেক ব্যয়বহুল। ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণে গড়ে ৬ মাস থেকে ২ বছর সময় লাগে।
২.গবেষকের ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব:- গবেষক নিজে অংশগ্রহণ করায় তার ব্যক্তিগত মতামত ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। ২০০২ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০% ক্ষেত্রে গবেষকের পক্ষপাতিত্ব তথ্য বিকৃত করে।
৩.নৈতিক দ্বন্দ্ব:- গবেষক যদি গোপনীয়তা রক্ষা না করেন, তাহলে এটি নৈতিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। ১৯৯৫ সালের একটি ঘটনায় দেখা গেছে, একজন গবেষক স্থানীয়দের গোপন তথ্য প্রকাশ করায় তাদের ক্ষতি হয়েছিল।
৪.তথ্যের সাধারণীকরণের সমস্যা:- এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত তথ্য কেবল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে প্রয়োগ করা যায় না। ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ২০% ক্ষেত্রে এই তথ্য সাধারণীকরণ সম্ভব।
৫.শারীরিক ও মানসিক চাপ:- গবেষককে দীর্ঘদিন অপরিচিত পরিবেশে থাকতে হয়, যা মানসিকভাবে ক্লান্তিকর। ২০২০ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৫০% গবেষক এই পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়ে মানসিক চাপের শিকার হন।
৬.তথ্য বিশ্লেষণের জটিলতা:- এই পদ্ধতিতে প্রচুর গুণগত তথ্য সংগ্রহ হয়, যা বিশ্লেষণ করা সময়সাপেক্ষ ও কঠিন। ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০% গবেষক এই বিশাল ডেটা সেটকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সমস্যায় পড়েন।
৭.গবেষকের নিরাপত্তা ঝুঁকি:- গবেষক যদি সংবেদনশীল বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাজ করেন, তাহলে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। ২০০৩ সালে আফগানিস্তানের একটি গবেষণায় একজন নৃবিজ্ঞানী অপহৃত হন, যা এই পদ্ধতির ঝুঁকি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
৮.অংশগ্রহণকারীদের প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন:- গবেষকের উপস্থিতির কারণে অংশগ্রহণকারীদের আচরণ পরিবর্তন হতে পারে, যা তথ্যের সত্যতাকে প্রভাবিত করে। ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৫% ক্ষেত্রে লোকেরা গবেষকের সামনে ভিন্নভাবে আচরণ করে।
৯.আইনি ও প্রশাসনিক বাধা:- কিছু দেশ বা সম্প্রদায়ে গবেষণার জন্য বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন, যা পেতে জটিলতা তৈরি হয়। ২০২০ সালের ইউনেস্কোর একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, ৩০% গবেষক আইনি জটিলতার কারণে তাদের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন।
উপসংহার:- অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি সামাজিক গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি গভীর ও বাস্তবসম্মত তথ্য প্রদান করে। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, যেমন সময়সাপেক্ষতা, পক্ষপাতিত্ব ও নৈতিক সমস্যা। সঠিক পরিকল্পনা ও নৈতিক নিয়ম মেনে চললে এই পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব।
একনজরে অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের সুবিধা ও অসুবিধা:-
অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ গবেষণায় গভীর ও বাস্তবসম্মত তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করে, যেমন মালিনowski-এর ১৯২০-এর গবেষণা। এটি সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে ও আস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে, তবে এটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। গবেষকের পক্ষপাতিত্ব ও নৈতিক সমস্যা এড়াতে সতর্কতা প্রয়োজন। ২০০৫ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত তথ্য ৪০% বেশি নির্ভরযোগ্য, কিন্তু ২০১৫ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, এর তথ্য সাধারণীকরণ করা কঠিন।
অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯২২ সালে মালিনowski-এর “Argonauts of the Western Pacific” গবেষণায় এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়। ১৯৬৭ সালে Oscar Lewis “La Vida” গবেষণায় পুয়ের্তো রিকান পরিবারের জীবনযাত্রা বর্ণনা করেন। ২০০১ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয়দের অংশগ্রহণ ৫০% বেশি সাফল্য আনে। তবে, ১৯৯০-এর দশকে Amazonian উপজাতির উপর গবেষণায় নৈতিক লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে, যা এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।