- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা:- প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাসে এথেন্স এক কিংবদন্তী নগররাষ্ট্র। এটি শুধু একটি নগরী ছিল না, ছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক প্রোজ্জ্বল কেন্দ্র। গণতন্ত্রের জন্মভূমি হিসেবে পরিচিত এথেন্স মানব ইতিহাসের পাতায় এক অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর রেখেছে। এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো একে অন্যান্য নগররাষ্ট্র থেকে আলাদা করেছিল এবং আজকের আধুনিক বিশ্বের বহু ধারণার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। নিম্নে এথেন্স নগর রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সমূহ বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
১.প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র: এথেন্স বিশ্বের প্রথম প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিল, যেখানে নাগরিকরা সরাসরি আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণে অংশ নিত। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪০ বার একত্রিত হয়ে নাগরিকরা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা আধুনিক পরোক্ষ গণতন্ত্রের তুলনায় এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা প্রদান করত।
২.সীমিত নাগরিকত্ব: এথেন্সের নাগরিকত্ব সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, যাদের পিতা-মাতা উভয়ই এথেনীয় বংশোদ্ভূত, তারাই নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতেন। নারী, দাস এবং বিদেশী অভিবাসীদের (মেটিকস) ভোটাধিকার বা রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ অব্দের এক জরিপ অনুযায়ী, এথেন্সের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২,৫০,০০০ জন হলেও, এর মধ্যে মাত্র ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ জন পূর্ণাঙ্গ নাগরিক ছিলেন।
৩.দাসপ্রথা: এথেন্সের অর্থনীতি ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল দাসপ্রথা। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এথেন্সে প্রায় ৮০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ দাস ছিল বলে অনুমান করা হয়, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এই দাসরা কৃষি, খনি, নির্মাণকাজ এবং গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থাকত। তাদের শ্রমের ওপর নির্ভর করেই এথেন্সের নাগরিকরা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেত।
৪. বিচার ব্যবস্থা: এথেন্সের বিচার ব্যবস্থা ছিল অনন্য। এখানে জুরি প্রথা প্রচলিত ছিল, যেখানে শত শত নাগরিক বিচারক হিসেবে কাজ করত। বিচারকদের সংখ্যা ২০০ থেকে ৬০০০ পর্যন্ত হতে পারত। এই বিশাল সংখ্যক জুরি সদস্যের উপস্থিতিতে নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে দার্শনিক সক্রেটিসের বিচার ছিল এথেন্সের বিচার ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা।
৫.শিক্ষা ও দর্শন: এথেন্স ছিল দর্শন ও শিক্ষার পীঠস্থান। সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মতো মহান দার্শনিকরা এখানেই তাদের চিন্তাধারা বিকাশ করেছিলেন। যুবকদের বক্তৃতা, যুক্তিবিদ্যা, সঙ্গীত এবং শরীরচর্চায় প্রশিক্ষিত করা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৪২৯ অব্দে পেরিক্লেসের বিখ্যাত বক্তৃতায় এথেন্সকে “হেল্লাসের বিদ্যালয়” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, যা তাদের শিক্ষাগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ।
৬.সামরিক শক্তি (নৌবাহিনী): এথেন্সের সামরিক শক্তির মূল ভিত্তি ছিল এর শক্তিশালী নৌবাহিনী। থেমিস্টোক্লেসের নেতৃত্বে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ অব্দে সালামিসের যুদ্ধে পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এথেন্সের নৌবাহিনী এক ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। এই নৌবাহিনী শুধুমাত্র প্রতিরক্ষাই দিত না, এথেন্সের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় এবং ডেলোস লীগের মাধ্যমে এর প্রভাব বিস্তারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
৭.ডেলোস লীগ: পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার জন্য এথেন্সের নেতৃত্বে খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ অবাব্দে ডেলোস লীগ গঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে এটি একটি সমবায়ী জোট হলেও, সময়ের সাথে সাথে এটি এথেন্সের সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। এই লীগের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এথেন্সকে কর দিত এবং এর মাধ্যমে এথেন্সের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আরও সুসংহত হয়েছিল।
৮.স্থাপত্য ও শিল্পকলা: এথেন্স স্থাপত্য ও শিল্পকলার এক স্বর্ণযুগ দেখেছিল। পার্থেনন, প্রোপিলিয়া এবং ইরেকথেইনের মতো স্থাপত্যগুলি পেরিক্লেসের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়েছিল, যা খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৫ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। এই স্থাপত্যগুলি শুধুমাত্র শিল্পের নিদর্শন ছিল না, এথেন্সের ক্ষমতা ও গৌরবকেও তুলে ধরেছিল।
৯.ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন: এথেন্সের জীবনে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী এথেনা সহ বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করা হতো। অলিম্পিক খেলাধুলা এবং ডায়োনিসাসের উৎসবের মতো ধর্মীয় উৎসবগুলি সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পিসিস্ট্রাটাসের শাসনামলে ডায়োনিসাসের সম্মানে নাটকীয় উৎসবের সূচনা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে এথেনীয় নাটকের বিকাশ ঘটায়।
১০.অর্থনৈতিক ভিত্তি: এথেন্সের অর্থনীতি মূলত বাণিজ্য, বিশেষ করে সামুদ্রিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। জলপাই তেল, ওয়াইন এবং মৃৎশিল্প ছিল তাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য। পিরিয়াস বন্দর ছিল ভূমধ্যসাগরের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এথেন্সের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল।
উপসংহার: প্রাচীন এথেন্স এক অসাধারণ নগররাষ্ট্র ছিল, যার বৈশিষ্ট্যগুলো আজও আধুনিক বিশ্বের বহু ধ্যানধারণাকে প্রভাবিত করে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, শক্তিশালী নৌবাহিনী এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তাদের অনুরাগ মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যেমন দাসপ্রথা ও সীমিত নাগরিকত্ব, তবুও এথেন্সের অবদান মানব প্রগতির এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
- প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
- সীমিত নাগরিকত্ব
- দাসপ্রথা
- বিচার ব্যবস্থা
- শিক্ষা ও দর্শন
- সামরিক শক্তি (নৌবাহিনী)
- ডেলোস লীগ
- স্থাপত্য ও শিল্পকলা
- ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন
- অর্থনৈতিক ভিত্তি
এথেন্সের গণতন্ত্র খ্রিস্টপূর্ব ৫০৮ সালে শুরু হলেও তা শুধু পুরুষ নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। নারী, দাস ও বিদেশীদের কোনো অধিকার ছিল না। পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধে (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১-৪০৪) স্পার্টার কাছে এথেন্স পরাজিত হয়, যা তার ক্ষমতা হ্রাস করে। অ্যারিস্টটলের মতে, এথেন্সের জনসংখ্যা খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে প্রায় ২,৫০,০০০ ছিল, যার মধ্যে মাত্র ৩০,০০০ ছিল ভোটদানের যোগ্য। এথেন্সের মুদ্রা “ড্রাকমা” পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যবহৃত হতো।