- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: রাষ্ট্রীয় কোষাগার সচল রাখার জন্য এবং দেশের জনগণের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ যেমন – রাস্তাঘাট নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি খাতে অর্থ জোগানোর প্রধান উপায় হলো কর। একটি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে কর। তাই এই কর আরোপের জন্য সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা অনুসরণ করে, যা একটি স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত করব্যবস্থা নিশ্চিত করে। এই নীতিমালাগুলোই হলো কর আরোপের মূল ভিত্তি।
১। ন্যায্যতা ও সমতা: ন্যায্যতা ও সমতার নীতি হলো কর আরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রত্যেক নাগরিক যেন তার আয় বা সামর্থ্য অনুসারে কর প্রদান করে। ধনী ব্যক্তিরা তাদের আয়ের বড় অংশ কর হিসেবে দেবে, আবার যাদের আয় কম, তাদের করের বোঝা হালকা হবে। এই নীতি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি সকলের মধ্যে ন্যায় ও সমতার অনুভূতি তৈরি করে। এটি নিশ্চিত করে যে করের বোঝা যেন সমাজের সব শ্রেণির মানুষের ওপর সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে একটি সুষম ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
২। নিশ্চয়তার নীতি: নিশ্চয়তার নীতি অনুযায়ী, একজন করদাতা কী পরিমাণ কর দেবে, কখন দেবে এবং কীভাবে দেবে—এই সবকিছু সুনির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ হতে হবে। কর আরোপের নিয়মাবলি যদি সহজ এবং স্পষ্ট না হয়, তাহলে করদাতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে, যা কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। তাই করের হার, কর প্রদানের সময়সীমা এবং পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জনসাধারণের জন্য সহজলভ্য রাখা প্রয়োজন। এই নীতি করব্যবস্থায় আস্থা তৈরি করে এবং করদাতাদের জন্য কর প্রদান প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
৩। সুবিধার নীতি: এই নীতির মূল কথা হলো, একজন ব্যক্তি কর প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় যেসব সুবিধা উপভোগ করে, তার ওপর ভিত্তি করে কর আরোপ করা। যেমন, যারা রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির মতো সরকারি সুবিধা বেশি ব্যবহার করে, তাদের কাছ থেকে বেশি কর নেওয়া যেতে পারে। তবে এই নীতির প্রয়োগ কিছুটা জটিল। কারণ, করের সঙ্গে প্রাপ্ত সুবিধার সরাসরি সম্পর্ক নির্ধারণ করা সব সময় সহজ হয় না। এই নীতিটির লক্ষ্য হলো, যারা জনসেবা থেকে বেশি উপকৃত হয়, তাদের কাছ থেকে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য বেশি অবদান নেওয়া।
৪। মিতব্যয়িতার নীতি: মিতব্যয়িতার নীতি বলতে বোঝায়, কর সংগ্রহের খরচ যেন কর থেকে প্রাপ্ত আয়ের তুলনায় নগণ্য হয়। যদি কর আদায় করতে গিয়ে সরকারের প্রচুর অর্থ ও জনবল ব্যয় হয়, তাহলে করের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। তাই এমন একটি করব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত, যা সহজে এবং কম খরচে পরিচালনা করা যায়। প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম ও স্বয়ংক্রিয় হিসাবরক্ষণ কর সংগ্রহকে আরও সাশ্রয়ী ও কার্যকর করতে পারে। এই নীতিটি সরকারের সম্পদ সংরক্ষণে সাহায্য করে এবং কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে।
৫। উৎপাদনশীলতার নীতি: উৎপাদনশীলতার নীতি হলো এমন একটি কৌশল, যার মাধ্যমে সরকার স্বল্প খরচে সর্বোচ্চ পরিমাণ কর সংগ্রহ করতে পারে। এই নীতি অনুযায়ী, করব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয় যেন করের হার সামান্য পরিবর্তন করেও সরকারের রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি করের ভিত্তি বড় হয় (অর্থাৎ, বেশি সংখ্যক পণ্য বা সেবার ওপর কর আরোপ করা হয়), তাহলে কম করের হার থেকেও বড় অঙ্কের রাজস্ব পাওয়া যায়। এই নীতিটি রাজস্ব সংগ্রহের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং সরকারের আর্থিক পরিকল্পনায় সাহায্য করে।
৬। স্থিতিস্থাপকতার নীতি: স্থিতিস্থাপকতার নীতি অনুসারে, করব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কর রাজস্বও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। যেমন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সময় মানুষের আয় বাড়লে সরকারের কর সংগ্রহও বেড়ে যায়, এবং মন্দার সময় আয় কমলে কর রাজস্বও কমে আসে। এই নীতিটি সরকারকে অর্থনৈতিক ওঠানামার সময় স্থিতিশীল থাকতে সহায়তা করে। করের হার বা ভিত্তি পরিবর্তন না করেও রাজস্বে এই পরিবর্তন আসে, যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আরও সহজ করে তোলে।
৭। বৈচিত্র্যের নীতি: এই নীতি অনুযায়ী, সরকারের রাজস্ব কেবল একটি বা দুটি উৎস থেকে আসা উচিত নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের কর থেকে আসা উচিত। যেমন – আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (VAT), আমদানি শুল্ক এবং সম্পত্তি কর ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের করব্যবস্থা থাকলে একটি নির্দিষ্ট খাতে মন্দা এলেও সরকারের রাজস্ব প্রবাহ স্থিতিশীল থাকে। এটি করদাতাদের ওপর চাপ কমায় এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস করে। বৈচিত্র্যপূর্ণ করব্যবস্থা একটি শক্তিশালী ও টেকসই রাজস্ব কাঠামো তৈরি করে।
উপসংহার: কর ধার্যের নীতিমালাগুলো একটি সুস্থ ও কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। এই নীতিমালাগুলো নিশ্চিত করে যে করব্যবস্থা শুধু রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যম নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার একটি হাতিয়ার। একটি সুষম ও সুপরিকল্পিত করনীতি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই নীতিমালাগুলো সঠিক ও কার্যকরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমেই একটি দেশ টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
- ন্যায্যতা ও সমতা
- নিশ্চয়তার নীতি
- সুবিধার নীতি
- মিতব্যয়িতার নীতি
- উৎপাদনশীলতার নীতি
- স্থিতিস্থাপকতার নীতি
- বৈচিত্র্যের নীতি
১৭৭৬ সালে প্রকাশিত অ্যাডাম স্মিথের বিখ্যাত গ্রন্থ “দ্য ওয়েলথ অব নেশনস”-এ কর ধার্যের চারটি মৌলিক নীতি, যেমন – ন্যায্যতা, নিশ্চয়তা, সুবিধা এবং মিতব্যয়িতা, প্রথম বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এই নীতিগুলো আজও আধুনিক করব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯২০ সালের দিকে আরও নতুন কিছু নীতি, যেমন – স্থিতিস্থাপকতা ও উৎপাদনশীলতা, যুক্ত হয়ে করব্যবস্থাকে আরও আধুনিক ও কার্যকর করে তোলে। পরবর্তীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে যে, যেসব দেশ এই নীতিগুলো অনুসরণ করে, সেখানে কর ফাঁকির হার তুলনামূলকভাবে কম।

