- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ধারণা হলো ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি। এটি ব্যাখ্যা করে যে, যখন কোনো ব্যক্তি কোনো নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবা ক্রমাগত ভোগ করতে থাকে, তখন প্রতিটি অতিরিক্ত একক থেকে প্রাপ্ত তৃপ্তি বা উপযোগ ক্রমশ কমতে থাকে। এই বিধিটি ভোক্তা আচরণের একটি সাধারণ প্রবণতাকে তুলে ধরে এবং চাহিদার নিয়মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি:- ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি অনুসারে, একজন ভোক্তা কোনো পণ্য যত বেশি পরিমাণে ভোগ করে, সেই পণ্যের প্রতিটি অতিরিক্ত একক থেকে তার প্রাপ্ত প্রান্তিক উপযোগ তত কমতে থাকে। এর মানে হলো, প্রথম আপেল থেকে যে তৃপ্তি পাওয়া যায়, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ আপেল থেকে সেই তৃপ্তি কমতে থাকে। একসময় এমন পরিস্থিতি আসে যখন অতিরিক্ত একক থেকে কোনো তৃপ্তিই পাওয়া যায় না, বরং তা বিরক্তি সৃষ্টি করে। এই নিয়মটি ভোক্তার ভোগের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে এবং চাহিদা রেখার নিম্নগামী হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে।
১।অধ্যপক মার্শাল বলেছেন, “কোন দ্রব্যের মজুদ বৃদ্ধির ফলে কোন ব্যক্তি যে অতিরিক্ত উপযোগ লাভ করে তা ঐ দ্রব্যের মজুদ বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমশ হ্রাস পায়।”
২।এইচ. এইচ. গোসেন (H. H. Gossen): “একই প্রয়োজনের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে ভোগ করার ফলে কমে যায় এবং এক সময় তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়।” এটি গোসেনের প্রথম সূত্র হিসেবে পরিচিত।
৩।সায়্যিদ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ (Sayyid Muhammad Abdullah): “কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দ্রব্যের ক্রমাগত ভোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তিক উপযোগ হ্রাস পায়।”
৪।স্যামুয়েলসন (Samuelson): “ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি অনুসারে, আপনি কোনো পণ্য যত বেশি ভোগ করবেন, সেই পণ্যের পরবর্তী একক থেকে প্রাপ্ত অতিরিক্ত উপযোগ (প্রান্তিক উপযোগ) তত কমতে থাকবে।”
৫।অর্থনীতিবিদ ব্যাপম্যান – এর মতে, “আমরা যতই একটি দ্রব্য ভোগ করি ততই দ্রব্যটির অতিরিক্ত একক ভোগ করতে চাই।”
৬।আর্নস্ট বাভার্ক (Ernst Böhm-Bawerk) এর মতে, “কোনো দ্রব্যের প্রতিটি পরবর্তী একক থেকে প্রাপ্ত উপযোগ, পূর্ববর্তী একক থেকে প্রাপ্ত উপযোগের চেয়ে কম হয়।”
৭।অর্থনীতিবিদ বোল্ডিং – এর মতে, “অন্যান্য দ্রব্যের বোগের কোনরূপ পরিবর্তন না করে যদি বিশেষ কোন একটি দ্রব্যের ভোগের পরিবর্তন করা হয় তবে পরিবর্তনীয় দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ ক্রমশ হ্রাস পায়।”
অনুমিতিগুলো:- নিম্নে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধির অনুমিতিসমূহ দেখানো হলো –
- ক. ভোক্তার মোট অভাব অসীম হলেও কোন নির্দিষ্ট দ্রব্যের অভাব পূরণ করা সম্ভব।
- খ. অভাব পূরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য একে অপরের সম্পূ্র্ণ পরিবর্তক হয় না।
- গ. ভোক্তার আচরণ যুক্তিশীল।
- ঘ. ভোক্তার আয়, রুচি ও পছন্দ ক্রম প্রদত্ত।
- ঙ. বিবেচনাধীন দ্রব্যের প্রতিটি সমজাতীয়।
- চ. বিবেচিত দ্রব্যের উপযোগ সংখ্যায় বা অর্থে পরিমাপযোগ্য।
- ছ. নির্দিষ্ট সময় বিবেচ্য।
- জ. ভোক্তা একসাথে দ্রব্যের প্রতিটি এককের ভোগ শেষ করবে।
তালিকা/সূচির মাধ্যমে ব্যাখ্যা:- দ্রব্য ভোগের ক্ষেত্রে প্রান্তিক উপযোগ এর তিনটি পর্যায় বিদ্যমান। নিচে সূচির সাহায্যে ক্রমহ্রাসমান প্রন্তিক উপযোগ বিধি ব্যাখ্যা করা হলো –
পর্যায় | দ্রব্যের একক | মোট উপযোগ | প্রান্তিক উপযোগ |
১ম পর্যায় | প্রথম একক | ১০ | ১০ |
দ্বিতীয় একক | ১৮ | ৮ | |
তৃতীয় একক | ২৪ | ৬ | |
চতুর্থ একক | ২৮ | ৪ | |
পঞ্চম একক | ৩০ | ২ | |
২য পর্যায় | ষষ্ঠ একক | ৩০ | ০ |
৩য় পর্যায় | সপ্তম একক | ২৯ | -১ |
আলোচ্য সূচিতে দেখা যাচ্ছে যে, ভোক্তা প্রথম পর্যায়ে প্রথম এককের জন্য ১০ টাকা দিতে রাজি থাকে। কারণ সে তা থেকে ১০ টাকার সম পরিমাণের উপযোগ পায়। প্রথম একক পাওয়ার পর অতিরিক্ত একক পাওয়ার জন্য তার আগ্রহ কিছুটা কমে যায় এবং দ্বিতীয় এককের জন্য ৮ টাকা দিতে রাজি থাকে। কারণ দ্বিতীয় একক হতে সে ৮ টাকার সমপরিমাণ উপযোগ পায়। একইভাবে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম একক ভোগের জন্য ভোক্তা যথাক্রমে ৬টাকা, ৪টাকা ও ২টাকা দিতে রাজি থাকে। ৬ষ্ট একক ভোগের জন্য ভোক্তা কোন মূল্য প্রদান করতে চায় না। কারণ তার এটার কোন আকাঙ্খা নেই। এখানে ৬ষ্ঠ এককের প্রন্তিক উপযোগ দ্বিতীয় পর্য়ায় নির্দেশ করে। কারণ ষষ্ঠ এককের প্রান্তিক উপযোগ শূন্যের সমান।
প্রান্তিক উপযোগ শূন্য অবস্থায় মোট উপযোগ সর্বাধিক হয়ে থাকে। এরপর ভোক্তার প্রান্তিক উপযোগ ঋণাত্নক হয়। অতএব, সপ্তম এককের প্রান্তিক উপযোগ ঋণাত্নক হয়। আর মোট উপযোগ হ্রাস পেতে শুরু করে। সুতরাং দেখা যায়, ভোক্তা যতই অধিক পরিমাণে কোন বিশষ দ্রব্য পেতে থাকে ততই তার প্রান্তিক উপযোগ কমতে থাকে। দ্রব্যের একক বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রান্তিক উপযোগ হ্রাস পাওয়ায় এ বিধিকে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি বলে।

চিত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা:- চিত্রের মতে, ভোক্তা ১ম এককের জন্য ১০ টাকা দিতে রাজি থাকে যা E দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। ভোক্তা দ্বিতীয় এককের জন্য ৮ টাকা দিতে রাজি থাকে যা F বিন্দু দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। এভাবে ৩য়, ৪র্থ, ৫ম এককের জন্য একজন ভোক্তা যথাক্রমে ৬, ৪, ও ২ টকা দিতে রাজি থাকে যা পর্যায়ক্রমে G H I বিন্দু দ্বারা দেখানো হয়েছে। একন E F G H ও I বিন্দুগুলো যোগ করে MU রেখা পাওয়া যায়। এ MU রেখাই ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ রেখা। আর তা বামদিক থেকে ডানদিকে নিম্নগামী। কারণ, ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধিতে দ্রব্যের পারিমাণ বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক উপযোগ হ্রাস পায়।
উপসংহার: প্রদত্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি একটি সার্বজনীন অর্থনৈতিক ধারণা। এটি ব্যাখ্যা করে যে, ভোগের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে প্রতিটি অতিরিক্ত একক থেকে প্রাপ্ত তৃপ্তি ক্রমশ কমতে থাকে। এই বিধি ভোক্তার যুক্তিসঙ্গত আচরণকে প্রতিফলিত করে এবং এটি চাহিদা রেখার নিম্নমুখী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এই ধারণাটি বাজার অর্থনীতিতে ভোক্তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করে।

