- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতির এক মৌলিক ধারণা হলো চাহিদা রেখা যা কোনো পণ্যের দামের সাথে তার চাহিদার পরিমাণের সম্পর্ক দেখায়। এই রেখাটি সাধারণত বাম থেকে ডান দিকে নিচের দিকে নেমে আসে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতিকে তুলে ধরে: যখন কোনো পণ্যের দাম কমে, তখন তার চাহিদা বাড়ে এবং যখন দাম বাড়ে, তখন তার চাহিদা কমে। এই সম্পর্কটিই অর্থনীতির মূল ভিত্তিগুলোর একটি।
১। আয় প্রভাব: যখন কোনো পণ্যের দাম কমে যায়, তখন ভোক্তার প্রকৃত আয় বেড়ে যায়। ধরুন, আপনি কোনো একটি পণ্য ১০০ টাকা দিয়ে কিনতে পারতেন, এখন সেই পণ্যের দাম ৮০ টাকা হয়ে গেছে। এর ফলে আপনার পকেটে ২০ টাকা বাড়তি থাকছে, যা দিয়ে আপনি অন্য কোনো পণ্য কিনতে পারেন অথবা সেই পণ্যটিই বেশি পরিমাণে কিনতে পারেন। এই বাড়তি ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, যার ফলে ওই পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এই কারণেই দাম কমার সাথে সাথে চাহিদা বাড়ে।
২। প্রতিস্থাপন প্রভাব: প্রতিস্থাপন প্রভাব হলো যখন একটি পণ্যের দাম কমে যায়, তখন ভোক্তারা তুলনামূলকভাবে বেশি দামের বিকল্প পণ্য বাদ দিয়ে কম দামের পণ্যটি কেনা শুরু করে। যেমন, চায়ের দাম কমে গেলে মানুষ কফির বদলে চা বেশি কিনবে। এর কারণ হলো, এখন চা কফির তুলনায় সস্তা। তাই কফির ভোক্তারা চা-এর দিকে ঝুঁকবে, ফলে চায়ের চাহিদা বেড়ে যাবে। এই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার কারণে চাহিদা রেখা নিম্নগামী হয়।
৩। ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি: যখন কোনো পণ্যের দাম কমে যায়, তখন একজন ভোক্তার সীমিত আয়ের মধ্যে সেই পণ্যটি বেশি পরিমাণে কেনার সামর্থ্য তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষার্থী যার মাসিক হাতখরচ সীমিত, সে যদি বইয়ের দাম কমে যেতে দেখে, তবে সে একই টাকায় আগের চেয়ে বেশি বই কিনতে পারবে। তার ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় সে আরও বেশি পণ্য কিনতে সক্ষম হয়। তাই দাম কমলে চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
৪। সীমিত উপযোগিতা: অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগিতা। এর অর্থ হলো, একজন ভোক্তা যখন কোনো একটি পণ্য বেশি পরিমাণে ভোগ করতে থাকে, তখন তার কাছে প্রতিটি অতিরিক্ত একক থেকে প্রাপ্ত তৃপ্তি বা উপযোগিতা ক্রমশ কমতে থাকে। তাই ভোক্তা যখন অতিরিক্ত একক পণ্য কিনতে চায়, তখন তাকে কম দাম দিতে ইচ্ছুক হয়। এই কারণে বিক্রেতারা বেশি পণ্য বিক্রি করার জন্য দাম কমাতে বাধ্য হয়, যা চাহিদা রেখাকে নিম্নগামী করে।
৫। নতুন ক্রেতার আগমন: যখন কোনো পণ্যের দাম কমে যায়, তখন নতুন অনেক ক্রেতা যারা আগে ওই পণ্যটি কিনতে পারতো না, তারা এখন সেই পণ্যটি কিনতে সক্ষম হয়। যেমন, একটি বিলাসবহুল গাড়ির দাম কমে গেলে যারা আগে সেই গাড়ি কেনার কথা ভাবতেও পারতো না, তারাও এখন সেই গাড়িটি কিনতে আগ্রহী হয়। এভাবে দাম কমার সাথে সাথে নতুন নতুন ক্রেতা বাজারে আসে, ফলে মোট চাহিদা বেড়ে যায়।
৬। মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: অনেক সময় দাম কমা বা বাড়ার সঙ্গে ক্রেতার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া জড়িত থাকে। যখন কোনো পণ্যের দাম কমানো হয়, তখন ক্রেতার মনে হয় এটি একটি ভালো সুযোগ। তারা ভাবে, এই দামে পণ্যটি না কিনলে তারা লাভজনক একটি সুযোগ হারাবে। এই মানসিকতার কারণে তারা কম দামে বেশি পণ্য কেনে। এই মনস্তাত্ত্বিক কারণও চাহিদা রেখার নিম্নগামী হওয়ার পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
৭। সম্পদের মূল্য: দাম কমার ফলে ভোক্তার সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ধরুন, একজন ক্রেতার কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আছে। যখন একটি পণ্যের দাম কমে যায়, তখন সেই অর্থ দিয়ে তিনি আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য কিনতে পারেন। এর মানে হলো, তার কাছে থাকা অর্থের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গেছে। এই ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে চাহিদা বাড়ে, যা চাহিদা রেখাকে নিম্নগামী করে।
৮। ভোক্তার বহুমুখিতা: অনেক সময় দেখা যায়, একটি পণ্যের দাম বাড়লে মানুষ সেই পণ্যটির বিভিন্ন বিকল্প খোঁজে। যেমন, মুরগির মাংসের দাম বাড়লে মানুষ মাছ বা গরুর মাংসের দিকে ঝুঁকতে পারে। আবার, মুরগির মাংসের দাম কমলে তারা মাছ বা গরুর মাংসের পরিবর্তে মুরগির মাংসই বেশি কিনতে চাইবে। এই বহুমুখী চাহিদার কারণেও দামের সাথে চাহিদার বিপরীত সম্পর্ক তৈরি হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, চাহিদা রেখার নিম্নগামী হওয়ার পেছনে একাধিক অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণ কাজ করে। এই রেখাটি শুধু দাম এবং চাহিদার মধ্যকার সম্পর্কই বোঝায় না, বরং ভোক্তার আচরণ, বাজারের গতিপ্রকৃতি এবং অর্থনীতির মৌলিক নীতিগুলোকেও তুলে ধরে। এটি অর্থনীতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা বাজার বিশ্লেষণ এবং অর্থনৈতিক নীতির প্রণয়নে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।
- ১। আয় প্রভাব
- ২। প্রতিস্থাপন প্রভাব
- ৩। ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি
- ৪। সীমিত উপযোগিতা
- ৫। নতুন ক্রেতার আগমন
- ৬। মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
- ৭। সম্পদের মূল্য
- ৮। ভোক্তার বহুমুখিতা
১৯ শতকের শেষের দিকে আলফ্রেড মার্শাল তার Principles of Economics (১৮৯০) গ্রন্থে চাহিদা এবং যোগানের এই মৌলিক সম্পর্কটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন, যা আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই তত্ত্বটি ১৯২৯ সালের মহামন্দা-এর সময় বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা বা মূল্যস্ফীতির সময় এই নীতিগুলো ব্যবহার করে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এই ধারণার মূল ভিত্তি হলো ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগিতা তত্ত্ব, যা প্রথম দিকে হেনরিচ গোসেন এবং কার্ল মেঙ্গার-এর মতো অর্থনীতিবিদদের দ্বারা আলোচিত হয়েছিল।

