- readaim.com
- 0
উত্তর::উপস্থাপনা:- পশুপালন মানব সমাজের এক প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যাযাবর জীবন থেকে স্থিতিশীল সমাজ গঠনে এই প্রথার ভূমিকা অনস্বীকার্য। খাদ্য, বস্ত্র, এবং কৃষিকাজের অপরিহার্য অংশ হিসেবে পশুপালন শুধু অর্থনৈতিক গুরুত্বই বহন করে না, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এর গভীর প্রভাব বিদ্যমান। কালের বিবর্তনে পশুপালনের ধরণ পরিবর্তিত হলেও, সমাজের মৌলিক চাহিদা পূরণে এর অবদান আজও অটুট রয়েছে।
১।খাদ্য ও পুষ্টির উৎস: পশুপালন সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি খাদ্য ও পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। গৃহপালিত পশু যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি থেকে মানুষ মাংস, দুধ, ডিম, এবং অন্যান্য পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য লাভ করে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সমাজেও প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে পশুপালনের ভূমিকা অপরিহার্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পশুপালনের উপর নির্ভরশীল।
২।অর্থনৈতিক গুরুত্ব: পশুপালন বহু মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর অবদান অত্যন্ত significant. দুধ, মাংস, ডিম বিক্রি করে যেমন আর্থিক উপার্জন হয়, তেমনি চামড়া, পশম এবং অন্যান্য উপজাত দ্রব্য বিক্রি করেও অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি বড় অংশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনে পশুপালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য এবং এটি ক্রমশ বাড়ছে।
৩।কৃষি কাজের সহায়ক: পশুপালন ঐতিহ্যগতভাবে কৃষি কাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পশু যেমন জমি চাষের জন্য লাঙ্গল টানতে ব্যবহৃত হয়, তেমনি পরিবহনের কাজেও এদের ব্যবহার রয়েছে। এছাড়াও, পশুর মলমূত্র জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করা যায়। আধুনিক কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়লেও, অনেক অঞ্চলে এখনও পশু কৃষি কাজের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
৪।সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য: পশুপালন সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে পশু বলি দেওয়া বা পশু দান করা একটি প্রচলিত প্রথা। অনেক সংস্কৃতিতে বিশেষ বিশেষ পশুদের পবিত্র জ্ঞান করা হয় এবং তাদের পূজা করা হয়। যাযাবর বা আধা-যাযাবর সমাজে পশুর মালিকানা সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। :-
৫।বসতি স্থাপনে প্রভাব: পশুপালনের ধরণ মানুষের বসতি স্থাপনের উপর প্রভাব ফেলে। যাযাবর পশুপালক সম্প্রদায় পশুদের খাদ্য ও পানির সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে, কৃষিকাজের সাথে যুক্ত পশুপালকেরা সাধারণত স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, পশুপালনের প্রয়োজনে অনেক গোষ্ঠী নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এবং ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলে।
৬।জ্ঞানের বিকাশ ও হস্তান্তর: পশুপালন একটি বিশেষ ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতার জন্ম দেয়। পশুদের প্রজনন, পরিচর্যা, রোগ প্রতিরোধ এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়। স্থানীয় পরিবেশ ও পশুর জাত সম্পর্কে পশুপালকদের অর্জিত জ্ঞান অনেক সময় বিজ্ঞানীদের কাছেও মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে।
৭।পরিবেশের উপর প্রভাব: পশুপালনের পরিবেশগত প্রভাব ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে। সঠিকভাবে পশু পালন করলে পশুর মলমূত্র ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব সার তৈরি করা যায়। তবে অতিরিক্ত পশুচারণ ভূমি degradation এবং বনভূমি ধ্বংসের কারণ হতে পারে। মিথেন গ্যাসের নিঃসরণের কারণেও পশুপালন বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অবদান রাখে। টেকসই পশুপালন practices এর মাধ্যমে পরিবেশের উপর এই নেতিবাচক প্রভাব কমানো সম্ভব। :-
৮।প্রযুক্তির ব্যবহার: আধুনিক পশুপালন ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। পশুদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, খাদ্য সরবরাহ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। স্মার্ট ফার্মিং-এর ধারণা পশুপালনকে আরও বিজ্ঞানসম্মত ও লাভজনক করে তুলছে।
৯।বাজার অর্থনীতির সাথে সংযোগ: বর্তমানে পশুপালন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। দুধ, ডিম, মাংস এবং অন্যান্য প্রাণিজ পণ্যের একটি বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। এই বাজার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় স্তরেই বিস্তৃত। পশুপালনের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ চেইনের মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
১০।রোগ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি: পশুপালনের সাথে কিছু রোগ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিও জড়িত। জুনোটিক রোগ অর্থাৎ পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে এমন রোগের বিস্তার একটি উদ্বেগের কারণ। এছাড়াও, পশুদের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়লে খামারিদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। তাই পশু স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উপসংহার:-পরিশেষে বলা যায়, পশুপালন শুধু একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, এটি মানব সমাজের বহুবিধ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। খাদ্য নিরাপত্তা, জীবিকা, সংস্কৃতি এবং পরিবেশের সাথে এর গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। কালের পরিক্রমায় পশুপালনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এলেও, মানব সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়নে এর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। টেকসই এবং বিজ্ঞানসম্মত পশুপালন practices এর মাধ্যমে সমাজ এর সুফল দীর্ঘকাল ধরে ভোগ করতে পারে।
- খাদ্য ও পুষ্টির উৎস
- অর্থনৈতিক গুরুত্ব
- কৃষি কাজের সহায়ক
- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
- বসতি স্থাপনে প্রভাব
- জ্ঞানের বিকাশ ও হস্তান্তর
- পরিবেশের উপর প্রভাব
- প্রযুক্তির ব্যবহার
- বাজার অর্থনীতির সাথে সংযোগ
- রোগ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি
ঐতিহাসিকভাবে, প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম পশুপালন শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে এটি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা যেমন মিশরীয়, সিন্ধু এবং মেসোপটেমীয় সভ্যতায় পশুপালনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের শুরুতে পশুচিকিৎসা বিজ্ঞান এবং পশু প্রজনন প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে পশুপালনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বর্তমানে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উন্নত জাতের পশু উৎপাদন এবং দুগ্ধ উৎপাদনে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথ (OIE) আন্তর্জাতিকভাবে পশু স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

