- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা:- জীবনে পদমর্যাদা অর্জনের দুটি প্রধান উপায় রয়েছে—প্রাপ্ত পদমর্যাদা ও অর্জিত পদমর্যাদা। প্রাপ্ত পদমর্যাদা ব্যক্তির জন্ম, পরিবার বা সামাজিক অবস্থান থেকে লাভ করা হয়, অন্যদিকে অর্জিত পদমর্যাদা নিজের দক্ষতা, পরিশ্রম ও সাফল্যের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। এই দুটির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে, যা ব্যক্তির সামাজিক মূল্যায়ন ও স্বীকৃতিকে প্রভাবিত করে।
প্রাপ্ত পদমর্যাদা এবং অর্জিত পদমর্যাদার মধ্যে পার্থক্য:-
১. সংজ্ঞা ও উৎস :- প্রাপ্ত পদমর্যাদা হলো সেই মর্যাদা যা ব্যক্তি জন্মসূত্রে বা পরিবারের অবস্থানের কারণে পেয়ে থাকে। যেমন—রাজপরিবারের সদস্যদের পদমর্যাদা। অন্যদিকে, অর্জিত পদমর্যাদা হলো ব্যক্তির নিজের প্রচেষ্টা, শিক্ষা, পেশা ও সামাজিক অবদানের মাধ্যমে অর্জন করা সম্মান। উদাহরণস্বরূপ, একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের পদমর্যাদা তার অর্জিত।
২. স্থায়িত্ব :- প্রাপ্ত পদমর্যাদা সাধারণত স্থায়ী হয়, কারণ এটি পারিবারিক বা সামাজিক কাঠামোর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু অর্জিত পদমর্যাদা ব্যক্তির কর্ম ও সাফল্যের উপর নির্ভর করে, তাই এটি পরিবর্তনশীল। কোনো ব্যক্তি যদি তার দক্ষতা হারায়, তাহলে তার অর্জিত মর্যাদাও হ্রাস পেতে পারে।
৩. সামাজিক স্বীকৃতি :- প্রাপ্ত পদমর্যাদাকে সমাজ প্রথাগতভাবে মেনে নেয়, যেমন জমিদার বা জোতদারের পদবি। কিন্তু অর্জিত পদমর্যাদা ব্যক্তির সক্ষমতা ও অবদানের জন্য দেওয়া হয়, তাই এটি বেশি শ্রদ্ধার দাবিদার। সমাজে ডাক্তার, শিক্ষক বা বিজ্ঞানীদের মর্যাদা তাদের কর্মের জন্য স্বীকৃত।
৪. ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা :- প্রাপ্ত পদমর্যাদা লাভের জন্য ব্যক্তিকে কোনো প্রচেষ্টা করতে হয় না, এটি স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু অর্জিত পদমর্যাদার জন্য কঠোর পরিশ্রম, শিক্ষা ও দক্ষতা প্রয়োজন। একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনে বছরের পর বছর গবেষণা জড়িত।
৫. সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা :- প্রাপ্ত পদমর্যাদা প্রায়শই পুরনো সামাজিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে, যা কখনো কখনো বৈষম্যের সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, অর্জিত পদমর্যাদা সামাজিক গতিশীলতা বাড়ায় এবং মেধা ও পরিশ্রমের ভিত্তিতে ব্যক্তিকে এগিয়ে নেয়। এটি একটি আধুনিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক।
৬. মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব :- প্রাপ্ত পদমর্যাদা প্রাপ্ত ব্যক্তি আত্মতৃপ্তি বা অহংকারে ভুগতে পারেন, কারণ এটি তার নিজস্ব অর্জন নয়। কিন্তু অর্জিত পদমর্যাদা ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী ও গর্বিত করে, কারণ এটি তার নিজের সাধনার ফল।
৭. উদাহরণ :- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, জমিদারদের পদমর্যাদা ছিল প্রাপ্ত, যা ব্রিটিশ আমলে বংশানুক্রমিকভাবে দেওয়া হতো। অন্যদিকে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার অর্জন তার অর্জিত পদমর্যাদার উদাহরণ, যা তার সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য দেওয়া হয়েছে।
৮. আইনি স্বীকৃতি :- প্রাপ্ত পদমর্যাদা অনেক সময় আইনগতভাবে স্বীকৃত হয়, যেমন রাজতন্ত্র বা অভিজাত পদবী। কিন্তু অর্জিত পদমর্যাদা আইনের চেয়ে সামাজিক সম্মান ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীকৃত হয়, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি বা পেশাগত সার্টিফিকেশন।
৯. সামাজিক মূল্যবোধ :- আধুনিক সমাজে অর্জিত পদমর্যাদার মূল্য বেশি, কারণ এটি ব্যক্তির সত্যিকার সাফল্যকে প্রতিফলিত করে। প্রাপ্ত পদমর্যাদা এখনও কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি ক্রমশ তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে।
১০. ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রভাব :- প্রাপ্ত পদমর্যাদা ব্যক্তিকে নির্ভরশীল করে তুলতে পারে, কারণ এটি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু অর্জিত পদমর্যাদা ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী ও দায়িত্বশীল করে তোলে, কারণ এটি তার নিজের অর্জন।
উপসংহার:- প্রাপ্ত ও অর্জিত পদমর্যাদার মধ্যে পার্থক্য সমাজের গতিশীলতা ও ব্যক্তির মূল্যায়নকে নির্ধারণ করে। প্রাপ্ত পদমর্যাদা ঐতিহ্যকে ধারণ করলেও অর্জিত পদমর্যাদা আধুনিকতার প্রতীক। একটি সুস্থ সমাজ গঠনে উভয়ের সমন্বয় প্রয়োজন, তবে অর্জিত পদমর্যাদাই ব্যক্তির প্রকৃত সাফল্যকে তুলে ধরে।
এক নজরে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট:-
- 🔹 প্রাপ্ত পদমর্যাদা জন্মগত, অর্জিত পদমর্যাদা কর্মগত।
- 🔹 প্রাপ্ত মর্যাদা স্থায়ী, অর্জিত মর্যাদা পরিবর্তনশীল।
- 🔹 অর্জিত পদমর্যাদা বেশি শ্রদ্ধার দাবিদার।
- 🔹 প্রাপ্ত পদমর্যাদায় প্রচেষ্টা নেই, অর্জিত পদমর্যাদায় কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন।
- 🔹 প্রাপ্ত পদমর্যাদা সামাজিক কাঠামো টিকিয়ে রাখে, অর্জিত পদমর্যাদা গতিশীলতা আনে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষতা ও শিক্ষাভিত্তিক পদমর্যাদা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ৭০% বেশি ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশক থেকে অর্জিত পদমর্যাদার গুরুত্ব বেড়েছে, বিশেষত পেশাজীবী ও উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে। গ্যালাপের ২০২২ সালের জরিপে দেখা গেছে, ৮৫% তরুণ অর্জিত পদমর্যাদাকে প্রাপ্ত পদমর্যাদার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।

