- readaim.com
- 0
উত্তর।।ভূমিকা: প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ‘সাম্যবাদ’ এবং আধুনিক যুগের ‘সাম্যবাদ’ বা কমিউনিজম দুটি ভিন্ন ধারণা, যদিও উভয়ই একটি শোষণমুক্ত ও শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখায়। প্লেটোর সাম্যবাদ ছিল মূলত এক রাজনৈতিক ও দার্শনিক মতবাদ, যা রাষ্ট্রের শাসক এবং সৈনিক শ্রেণির জন্য পরিকল্পিত হয়েছিল। অন্যদিকে, আধুনিক সাম্যবাদ হলো একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতবাদ, যা সমাজ থেকে ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে চায়। এই দুটি ধারণার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা জরুরি, কারণ তাদের লক্ষ্য ও পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা।
১. আদর্শ রাষ্ট্র: প্লেটোর সাম্যবাদ ছিল একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত, যেখানে দার্শনিক রাজা এবং সামরিক শ্রেণির জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার ত্যাগ করার বিধান ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল, শাসক ও সৈনিকরা যেন ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে পারে। প্লেটো মনে করতেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং পারিবারিক মোহ রাষ্ট্র পরিচালনায় পক্ষপাতিত্ব তৈরি করে, তাই এই দুই শ্রেণি থেকে সেগুলিকে দূরে রাখা জরুরি। এটি ছিল রাষ্ট্রের নৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শকে উন্নত করার একটি প্রচেষ্টা। আধুনিক সাম্যবাদ, তবে, একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে, যেখানে সকল মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত হবে।
২. ব্যক্তিগত সম্পত্তি: প্লেটোর সাম্যবাদ কেবল রাষ্ট্রের শাসক ও সৈনিক শ্রেণির জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপের কথা বলেছিল, উৎপাদক শ্রেণির জন্য নয়। উৎপাদক শ্রেণি তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখতে পারত। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, সম্পত্তির মালিকানা শাসকশ্রেণিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। অন্যদিকে, আধুনিক সাম্যবাদ ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে এবং সমস্ত উৎপাদন ও সম্পদ রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসে। এর মূল লক্ষ্য হলো, সমাজের সকল স্তরে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। আধুনিক সাম্যবাদ সকল মানুষের জন্যই ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপের কথা বলে, যা প্লেটোর ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক।
৩. শ্রেণি বিভাজন: প্লেটোর সাম্যবাদে সমাজকে তিনটি সুস্পষ্ট শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল: শাসক (দার্শনিক রাজা), সৈনিক এবং উৎপাদক। এই শ্রেণি বিভাজন জন্মগত মেধা ও যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে ছিল, এবং প্রত্যেক শ্রেণির জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। এই ব্যবস্থায় একটি শ্রেণির মানুষ অন্য শ্রেণিতে যেতে পারত না। আধুনিক সাম্যবাদে, তবে, এই ধরনের শ্রেণি বিভাজনের কোনো স্থান নেই। আধুনিক সাম্যবাদের মূল লক্ষ্যই হলো সমাজের সকল প্রকার শ্রেণি বিভাজন দূর করে একটি শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে কোনো ব্যক্তি তার জন্মগত অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত হবে না।
৪. নারী ও পরিবার: প্লেটোর সাম্যবাদে শাসক ও সৈনিক শ্রেণির নারীদের জন্য পুরুষদের মতোই সম্পত্তির অধিকার ছিল। প্লেটো পরিবার প্রথার বিলোপ ঘটিয়ে এক ধরনের সম্মিলিত পরিবার গঠনের কথা বলেছিলেন, যেখানে নারীরাও পুরুষদের মতো সমানভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবে। এর মাধ্যমে তিনি পরিবারকে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। আধুনিক সাম্যবাদে, অবশ্য, পরিবার প্রথা বিলোপের কথা বলা হয় না। বরং, আধুনিক সাম্যবাদ নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি এবং কর্মক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা বলে, যা পারিবারিক সম্পর্কের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
৫. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: প্লেটোর সাম্যবাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি ন্যায়পরায়ণ ও আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে দার্শনিক রাজারা শাসন করবেন এবং তাদের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকবে না। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধন। আধুনিক সাম্যবাদের প্রধান লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক শোষণ দূর করা এবং একটি এমন সমাজ গঠন করা, যেখানে উৎপাদনের উপায়গুলো সকলের হাতে থাকবে। এর উদ্দেশ্য হলো, মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
৬. প্রয়োগের ক্ষেত্র: প্লেটোর সাম্যবাদ কেবল রাষ্ট্রের উচ্চ দুই শ্রেণি, অর্থাৎ শাসক ও সৈনিক শ্রেণির জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ উৎপাদক শ্রেণি এর আওতায় আসত না। এই ব্যবস্থাটি একটি কাল্পনিক আদর্শ রাষ্ট্র ‘রিপাবলিক’-এর জন্য প্লেটোর চিন্তা ছিল। আধুনিক সাম্যবাদ, তবে, সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের জন্য প্রযোজ্য এবং এর প্রয়োগ সর্বজনীন। এটি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য নয়, বরং সমগ্র মানব সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে।
৭. ভিত্তি: প্লেটোর সাম্যবাদের ভিত্তি ছিল নৈতিক ও দার্শনিক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞাই মানুষকে দুর্নীতি থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই, তার সাম্যবাদ ছিল মূলত শাসকদের নৈতিক শুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল। আধুনিক সাম্যবাদের ভিত্তি হলো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এর মতো দার্শনিকরা এই মতবাদের প্রবক্তা। আধুনিক সাম্যবাদ অর্থনৈতিক কাঠামো এবং শ্রেণির সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
৮. রাজনৈতিক ক্ষমতা: প্লেটোর সাম্যবাদে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল একচেটিয়াভাবে দার্শনিক রাজার হাতে। তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ জ্ঞানী এবং ন্যায়পরায়ণ শাসক। এখানে গণতন্ত্রের কোনো স্থান ছিল না। আধুনিক সাম্যবাদে রাজনৈতিক ক্ষমতা শ্রমিক শ্রেণির হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়, যাকে ‘প্রলেতারিয়েতদের একনায়কতন্ত্র’ বলা হয়ে থাকে। যদিও এর চূড়ান্ত লক্ষ্য রাষ্ট্রহীন এবং শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে না।
৯. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: প্লেটোর সাম্যবাদ প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছিল। সেই সময়কার রাষ্ট্রগুলো ছিল ছোট এবং তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো ছিল খুবই ভিন্ন। আধুনিক সাম্যবাদ শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠে, যখন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করে। কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলসের সময়ে শিল্প শ্রমিকদের শোষণ এই মতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলে।
১০. পদ্ধতি: প্লেটোর সাম্যবাদ একটি শান্তিপূর্ণ ও দার্শনিক পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে আদর্শ করে তোলার কথা বলেছিল। তার মতে, সঠিক শিক্ষা এবং নৈতিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। আধুনিক সাম্যবাদ, বিশেষ করে মার্কসবাদের মতে, বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণি সংগ্রাম ঘটিয়ে পুঁজিবাদের পতন ঘটাতে হবে। এটি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলে, যেখানে শ্রমিক শ্রেণি সহিংস সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবে।
উপসংহার: প্লেটোর সাম্যবাদ ও আধুনিক সাম্যবাদ দুটি ভিন্ন সময়ের ও ভিন্ন দর্শনের ফল। প্লেটোর চিন্তা ছিল মূলত একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের, যা নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির জন্য প্রযোজ্য ছিল। অন্যদিকে, আধুনিক সাম্যবাদ একটি অর্থনৈতিক বিপ্লবের কথা বলে, যা সমাজের সকল শ্রেণির বৈষম্য দূর করতে চায়। প্লেটোর সাম্যবাদ তার সময়ের প্রেক্ষাপটে এক বিপ্লবী চিন্তা হলেও, আধুনিক সাম্যবাদ বিশ্বজুড়ে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
- আদর্শ রাষ্ট্র
- ব্যক্তিগত সম্পত্তি
- শ্রেণি বিভাজন
- নারী ও পরিবার
- লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- প্রয়োগের ক্ষেত্র
- ভিত্তি
- রাজনৈতিক ক্ষমতা
- ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
- পদ্ধতি
কার্ল মার্কস তার ১৮৪৮ সালের ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে আধুনিক সাম্যবাদের মূলনীতিগুলো তুলে ধরেন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন। সেই সময় থেকে বিভিন্ন দেশে সাম্যবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলস্বরূপ বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের অনেক দেশে এই মতবাদ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

