- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: আমরা যে ভাষা এবং ভূখণ্ডকে বাংলা নামে জানি, তার ইতিহাসের শিকড় বহু পুরোনো। এই নামটি আজকের দিনে শুধু একটি ভৌগোলিক পরিচিতিই নয়, বরং এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। ‘বাংলা’ শব্দটি কীভাবে এলো, কালের যাত্রাপথে এর রূপান্তর ও বিস্তার কীভাবে হলো, তা জানা আমাদের আত্মপরিচয়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সহজভাবে বলতে গেলে, এই নামটির জন্ম ও বিবর্তন লুকিয়ে আছে ইতিহাসের ধূলিকণা এবং প্রাচীন জনপদের লোককাহিনিতে।
১।বঙ্গ জনপদ: বঙ্গ নামটি থেকেই আজকের বাংলা নামের মূল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রাচীনকালে এই ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে ‘বঙ্গ’ নামক একটি শক্তিশালী জনপদের অস্তিত্ব ছিল। এই জনপদটি ছিল মূলত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের একটি বিস্তৃত এলাকা, যা কৃষি ও বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল, এবং সময়ের সাথে সাথে এই নামের প্রভাব এতই বেড়ে যায় যে এটি সমগ্র অঞ্চলকে নির্দেশ করতে শুরু করে। তাই, ‘বঙ্গ’ থেকে যে ‘বাংলা’ নামের উদ্ভব, তা ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক উভয় দিক থেকেই অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত।
২।’আল’ এর সংযোগ: ঐতিহাসিকদের মতে, বঙ্গ নামের সাথে ‘আল’ শব্দটি যুক্ত হয়ে ‘বঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গালা’ নামের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলের মানুষেরা তাদের চাষের জমিকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করার জন্য মাটির উঁচু বাঁধ বা আইল তৈরি করত, যা স্থানীয় ভাষায় ‘আল’ নামে পরিচিত ছিল। কিংবদন্তি অনুসারে, এই ‘আল’ বা বাঁধগুলিই এই জনপদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। ফার্সি ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে এই তত্ত্বটিকে সমর্থন করেছেন। এই ‘আল’ এর সংযোগেই ‘বঙ্গ’ রূপান্তরিত হয়ে ‘বাংলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে, যা এক অনন্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকেও তুলে ধরে।
৩।গৌড় সাম্রাজ্য: একসময় সমগ্র বাংলাকে একক নামে পরিচিত করার আগে, এই অঞ্চলে ‘গৌড়’ নামেও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিল। উত্তর ও পশ্চিম বাংলার বৃহৎ অংশজুড়ে এই রাজ্যের প্রভাব ছিল। বিভিন্ন সময়ে ‘গৌড়’ এবং ‘বঙ্গ’ এই দুটি নাম একে অপরের প্রতিস্থাপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা নামের উৎপত্তির ইতিহাসকে কিছুটা জটিল করে তোলে। পাল ও সেন রাজাদের সময়কালে গৌড় ছিল একটি সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী প্রশাসনিক কেন্দ্র। যদিও পরবর্তীকালে মুসলিম শাসনামলে ‘বাংলা’ নামটিই অধিক প্রাধান্য লাভ করে, তবুও গৌড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এই অঞ্চলের নামকরণের বিবর্তনে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
৪।সুলতানি আমল: চতুর্দশ শতকে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন ছোট রাজ্যকে একত্রিত করে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজেকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’ বা ‘বাংলার সুলতান’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই সময় থেকেই ‘বাঙ্গালা’ বা ‘বাংলা’ নামটি একক প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক পরিচিতি লাভ করে এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এর আগে বিভিন্ন অঞ্চলে ‘বঙ্গ’, ‘গৌড়’, ‘রাঢ়’ ইত্যাদি নাম প্রচলিত থাকলেও, ইলিয়াস শাহের হাত ধরেই ‘বাংলা’ নামটি একটি সার্বভৌম রাজ্যের নাম হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। এই যুগেই নামটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
৫।ভাষার ভূমিকা: এই অঞ্চলের জনগণের মুখের ভাষা ‘বাংলা’-ও নামের উৎপত্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, কোনো অঞ্চলের ভাষা এবং সেই অঞ্চলের নাম প্রায়শই একে অপরের ওপর প্রভাব ফেলে। এই অঞ্চলের মানুষজন যে ভাষায় কথা বলত, সেই ভাষার নামানুসারেও সমগ্র অঞ্চলটি ‘বাংলা’ নামে পরিচিতি লাভ করতে পারে। ভাষা এবং অঞ্চলের নামের এই পারস্পরিক সম্পর্কটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। মধ্যযুগের সাহিত্যেও ‘বঙ্গ ভাষা’ এবং ‘বঙ্গ দেশ’ উভয়টিরই উল্লেখ পাওয়া যায়, যা নামের উৎপত্তিতে ভাষার গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে।
৬।বিদেশি প্রভাব: বাংলার নামের উৎপত্তিতে বিদেশি পর্যটক ও শাসকদেরও কিছুটা প্রভাব রয়েছে। মুসলিম শাসকরা এই অঞ্চলকে ‘বাঙ্গালাহ’ বা ‘বাঙ্গালা’ নামে অভিহিত করতেন, যা ফার্সি ভাষার মাধ্যমে প্রচলিত হয়েছিল। আবার ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ও ঔপনিবেশিক শক্তিগুলিও এই অঞ্চলকে ‘বেঙ্গল’ (Bengal) নামে উল্লেখ করত, যা ‘বাঙ্গালা’ শব্দেরই অপভ্রংশ। এই বিদেশি উচ্চারণ ও লিখিত রূপগুলিও সময়ের সাথে সাথে নামের বৈচিত্র্য এবং বিস্তারে সহায়তা করেছে। এই বিদেশী শব্দগুলির মাধ্যমে ‘বাংলা’ নামটি আন্তর্জাতিক পরিচিতিও লাভ করে।
৭।প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য: বাংলার নামের পেছনে এই অঞ্চলের অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ নদী-নালা, খাল-বিল এবং ঘন ব-দ্বীপের ভূমিকার কথা বলা হয়। ‘আল’ তত্ত্বটি যেমন বাঁধের কথা বলে, তেমনি এই অঞ্চলের ভেজা ও কাদা মাটির কারণে সৃষ্ট ‘বাঙ’ বা ‘বঙ্গ’ শব্দটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। এই প্রকৃতিই এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং জনপদের বিন্যাসকে প্রভাবিত করেছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কই এই অঞ্চলের নামের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে, যা ‘বাংলা’ নামের উৎপত্তির পেছনে একটি বিশেষ কারণ হিসেবে কাজ করে।
৮।আলাদা অঞ্চল: প্রাচীন ভারতে ‘বঙ্গ’ থেকে আলাদা করে এই অঞ্চলটিকে চিহ্নিত করতে ‘বাঙ্গালা’ বা ‘বাংলা’ নামের ব্যবহার শুরু হয়। অনেক সময় একটি ছোট বা নির্দিষ্ট জনপদ থেকে উদ্ভূত নামই ধীরে ধীরে বৃহত্তর অঞ্চলের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রাচীন বঙ্গ ছিল ছোট একটি অঞ্চল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই নাম যখন উত্তরে গৌড়, পশ্চিমে রাঢ় এবং পূর্বে সমতটকে অন্তর্ভুক্ত করে, তখন এই বৃহত্তর প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ভূখণ্ডের জন্য একটি নতুন ও সর্বজনীন নামের প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজনেই ‘বাংলা’ নামটি তার চূড়ান্ত পরিচিতি লাভ করে।
৯।রাজনৈতিক ঐক্য: বাংলার নামের উৎপত্তির মূলে রয়েছে রাজনৈতিক ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা। বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্য ও জনপদকে একটি একক প্রশাসনিক ছাতার নিচে আনার যে চেষ্টা সুলতান ইলিয়াস শাহ শুরু করেছিলেন, সেই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ একটি একক নাম ‘বাংলা’ প্রতিষ্ঠা পায়। এই নামটি শুধু একটি ভৌগোলিক এলাকার নাম ছিল না, এটি ছিল সেই সময়ের মানুষের একত্রিত হওয়ার এবং একটি স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা গড়ে তোলার প্রতীক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ঐক্যবদ্ধ শাসনের প্রতীক হিসেবে ‘বাংলা’ নামটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং স্থায়ী পরিচিতি লাভ করে।
উপসংহার: আলোচনা থেকে বোঝা যায়, বাংলা নামের উৎপত্তি কোনো একক কারণ বা দিনে ঘটেনি। এটি প্রাচীন বঙ্গ জনপদ থেকে শুরু করে ‘আল’ তত্ত্ব, গৌড়ের প্রভাব এবং সুলতানি আমলের রাজনৈতিক ঐক্য – সবকিছুর সম্মিলিত ফল। বিদেশি শাসক ও ভাষার প্রভাবও এই নামের রূপান্তরে সহায়তা করেছে। এই নামটি কেবল একটি দেশের বা অঞ্চলের নাম নয়, এটি হাজার বছরের ঐতিহ্য, ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। তাই ‘বাংলা’ নামটির ইতিহাস জানা মানে আমাদের নিজস্ব পরিচয়কে আরও গভীরভাবে অনুভব করা।
১. 🔹 বঙ্গ জনপদ ২. 🔹 ‘আল’ এর সংযোগ ৩. 🔹 গৌড় সাম্রাজ্য ৪. 🔹 সুলতানি আমল ৫. 🔹 ভাষার ভূমিকা ৬. 🔹 বিদেশি প্রভাব ৭. 🔹 প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ৮. 🔹 আলাদা অঞ্চল ৯. 🔹 রাজনৈতিক ঐক্য।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ প্রথম বিভিন্ন অঞ্চলকে একত্রিত করে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ উপাধি ধারণ করেন, যা বাংলাকে একটি রাজনৈতিক পরিচিতি দেয়। মুঘল সম্রাট আকবরের অর্থমন্ত্রী টোডরমল ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দের জরিপে এই অঞ্চলকে ‘সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ নামে উল্লেখ করেন। আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে আবুল ফজল ‘আল’ বা বাঁধের সঙ্গে নামের উৎপত্তির সম্পর্কটি উল্লেখ করেছেন, যা এই নামের ঐতিহাসিক ভিত্তি মজবুত করে।

