- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: বাজার অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হলো প্রতিযোগিতা, আর এই প্রতিযোগিতার এক বিশেষ ও আদর্শায়িত রূপ হলো বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা। অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় এই ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একটি বাজারের সবচেয়ে সরল ও কার্যকর কাঠামোকে তুলে ধরে। যদিও বাস্তব জগতে এমন বাজারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন, তবুও এই মডেলটি অন্যান্য বাজার কাঠামোকে বিশ্লেষণ ও বোঝার জন্য একটি মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই বিশেষ বাজার কাঠামোটি বিক্রেতা ও ক্রেতা—উভয়কেই তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ প্রদান করে।
শাব্দিক অর্থ:- ‘বিশুদ্ধ’ (Pure) শব্দের অর্থ হলো খাঁটি বা ভেজালমুক্ত, যেখানে কোনো প্রকার অপূর্ণতা বা বাধা নেই। আর ‘প্রতিযোগিতা’ (Competition) বলতে বোঝায় একাধিক পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অর্থাৎ, বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা হলো এমন একটি বাজার ব্যবস্থা যেখানে প্রতিযোগিতা সম্পূর্ণরূপে অবাধ ও মুক্ত।
অর্থনীতিতে বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা হলো একটি কাল্পনিক বা আদর্শ বাজার কাঠামো, যেখানে অসংখ্য ক্রেতা এবং বিক্রেতা সমজাতীয় (Homogeneous) পণ্য লেনদেন করে। এই বাজারে কোনো একক ক্রেতা বা বিক্রেতার পণ্যের দাম বা সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলার ক্ষমতা থাকে না। বিক্রেতারা এখানে কেবল দাম গ্রহণকারী (Price Taker) হিসেবে কাজ করে। মূলত, বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা হলো পূর্ণ প্রতিযোগিতার (Perfect Competition) সেই অংশ, যেখানে পূর্ণ জ্ঞান (Perfect Knowledge) এবং উৎপাদনের উপকরণের পূর্ণ গতিশীলতা (Perfect Mobility of Factors of Production) এই দুটি বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত থাকে। তবে অনেকে বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা এবং পূর্ণ প্রতিযোগিতাকে একই অর্থে ব্যবহার করেন।
অর্থনীতিবিদগণ বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা-কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সজ্ঞায়িত করেছেন:
১।এডওয়ার্ড চেম্বারলিন: যখন একটি বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা এত বেশি থাকে যে কোনো একক বিক্রেতা বা ক্রেতা পণ্যের বাজার মূল্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে না এবং পণ্যগুলি সমজাতীয় হয়, তখন সেই অবস্থাকে বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা বলে।
২।অধ্যাপক স্যামুয়েলসন: বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা বলতে আমরা এমন একটি বাজারকে বুঝি যেখানে অগণিত স্বাধীন ফার্ম একই পণ্য বিক্রি করে এবং যেখানে দামের উপর কোনো ফার্মেরই নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
৩।অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক নাইট: বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা হলো এমন একটি অবস্থা যখন প্রতিটি ক্রেতা ও বিক্রেতার পক্ষে বাজারের পণ্য বা সেবার সরবরাহ ও চাহিদার পরিবর্তনের কারণগুলি জানা থাকে এবং এই তথ্যগুলির ভিত্তিতে তারা যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেয়।
৪।অধ্যাপক ই. এ. জি. রবিনসন: কোনো বাজারে যদি অসংখ্য ক্রেতা-বিক্রেতা থাকে এবং প্রতিটি বিক্রেতা এমন পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করে যা বাজারের মোট সরবরাহের তুলনায় নগণ্য, তবে সেই বাজারকে বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতার বাজার বলা চলে।
৫।জোয়ান রবিনসন: বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান থাকে যখন প্রতিটি উৎপাদকের কাছে তার উৎপন্ন পণ্যের জন্য চাহিদা রেখাটি পূর্ণ স্থিতিস্থাপক (Perfectly Elastic) হয়।
৬।ডব্লিউ. জে. বামোল: বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা এমন একটি বাজার ব্যবস্থা যেখানে প্রবেশ ও প্রস্থান সম্পূর্ণরূপে অবাধ এবং প্রত্যেক ক্রেতা ও বিক্রেতা বাজারের দাম সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।
উপরের বিশেষজ্ঞ মতামতগুলির ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা হলো একটি আদর্শায়িত বাজার কাঠামো যেখানে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্রেতা ও বিক্রেতা একটি সমজাতীয় পণ্য নিয়ে কাজ করে। এই বাজারে কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা থাকে না, বরং তারা বাজার নির্ধারিত দাম মেনে নেয়। এই বাজারের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হলো পণ্যের সমরূপতা এবং ক্রেতা-বিক্রেতার বিপুল সংখ্যা, যা নিশ্চিত করে যে প্রতিযোগিতা সম্পূর্ণরূপে অবাধ ও নির্মল।
উপসংহার: বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা অর্থনীতিতে একটি তাত্ত্বিক মডেল হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি বাজার কাঠামো এবং দাম নির্ধারণের মূলনীতি বোঝার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে। এই ধারণাটি বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, যখন বাজারে কোনো একচেটিয়া ক্ষমতা থাকে না এবং প্রতিযোগিতা অবাধ থাকে, তখন সম্পদ সবচেয়ে কার্যকরভাবে বন্টিত হয়। তাই, নীতি নির্ধারক এবং গবেষকদের কাছে এই মডেলটি বাজারের দক্ষতা এবং অপূর্ণতা পরিমাপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা হলো এমন এক বাজার ব্যবস্থা, যেখানে অসংখ্য ক্রেতা ও বিক্রেতা সমজাতীয় পণ্য লেনদেন করে এবং তারা বাজার নির্ধারিত দাম গ্রহণে বাধ্য থাকে।
বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতার ধারণাটি ১৯৩৩ সালে এডওয়ার্ড চেম্বারলিন তার থিওরি অফ মনোপলিস্টিক কম্পিটিশন গ্রন্থে প্রথম ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে অর্থনীতিতে ১৯৫০-এর দশক থেকে এই বাজারের মডেলকে অন্যান্য কাঠামোর কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য একটি মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি ২০১৮ সালের জরিপ দেখায় যে, কৃষিজাত পণ্য যেমন চাল, গম ইত্যাদির বাজারকে প্রায়শই বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতার নিকটবর্তী উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, যদিও বাস্তবে পূর্ণ প্রতিযোগিতার সব শর্ত পূরণ করা অসম্ভব।

