- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: আমাদের চারপাশে নানা ধরনের পণ্য ও পরিষেবা বিদ্যমান। এর মধ্যে কিছু জিনিস আমরা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করি, আবার কিছু জিনিস সবাই মিলে একসাথে ব্যবহার করি। এই দুই ধরনের পণ্যের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা অর্থনীতি ও সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত দ্রব্য এবং গণদ্রব্যের এই পার্থক্য বোঝা আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সরকারি নীতির কার্যকারিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। এই লেখায় আমরা সহজ ভাষায় এই দুই ধরনের দ্রব্যের মূল পার্থক্যগুলো আলোচনা করব।
১। বর্জনযোগ্যতা: ব্যক্তিগত দ্রব্য এমন ধরনের পণ্য যা একজন ব্যক্তি অন্যকে তার ব্যবহার থেকে সহজেই বর্জন করতে পারে। অর্থাৎ, এই দ্রব্যগুলো ব্যবহার করার জন্য মূল্য পরিশোধ করতে হয় এবং যারা মূল্য দিতে রাজি নয়, তাদের এই পণ্য ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। যেমন, একটি স্মার্টফোন বা একটি পোশাক। আপনি যখন একটি পোশাক কেনেন, তখন কেবল আপনিই সেটি ব্যবহার করতে পারেন এবং অন্য কেউ সেটি ব্যবহার করতে পারে না, যদি না আপনি তাকে অনুমতি দেন। এই ধরনের দ্রব্যের ক্ষেত্রে, বিক্রেতা খুব সহজেই একজন ক্রেতাকে মূল্য পরিশোধের ওপর ভিত্তি করে পণ্যটি সরবরাহ করতে পারে।
২। প্রতিদ্বন্দ্বিতা: ব্যক্তিগত দ্রব্যের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। এর অর্থ হলো, একজন ব্যক্তি যখন কোনো ব্যক্তিগত দ্রব্য ব্যবহার করে, তখন অন্য কারো জন্য সেই দ্রব্যের ব্যবহার কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একটি আপেল কিনে খান, তাহলে সেই একই আপেল অন্য কেউ আর খেতে পারবে না। একইভাবে, একটি সিনেমা হলে একটি নির্দিষ্ট আসনে একজন দর্শক বসলে, সেই আসনে অন্য কোনো দর্শক বসতে পারে না। এই ধরনের পণ্যের ব্যবহার সীমিত এবং এর সরবরাহও সীমিত। তাই চাহিদা বাড়লে এর মূল্যও বেড়ে যায়।
৩। মূল্য নির্ধারণ: ব্যক্তিগত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করা সহজ। সাধারণত, বাজার অর্থনীতিতে সরবরাহ ও চাহিদার পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে এই ধরনের দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হয়। বিক্রেতা তার উৎপাদন খরচ এবং মুনাফার লক্ষ্য বিবেচনা করে একটি দাম স্থির করে। ক্রেতা যদি সেই দামে পণ্যটি কিনতে ইচ্ছুক হয়, তাহলেই লেনদেন সম্পন্ন হয়। যেমন, একটি দোকানে একটি বিস্কুটের দাম নির্দিষ্ট থাকে এবং ক্রেতা সেই দাম পরিশোধ করে বিস্কুটটি কেনে। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং বাজারভিত্তিক।
৪। গণদ্রব্য: গণদ্রব্য এমন একটি পণ্য বা পরিষেবা যা কোনো একক ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করে না, বরং সমাজের সকলে মিলে একত্রে ব্যবহার করে। এই ধরনের দ্রব্যের ক্ষেত্রে বর্জনযোগ্যতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা—কোনোটাই থাকে না। যেমন, একটি দেশের রাস্তা, সেতু, বা জাতীয় নিরাপত্তা। এই সুবিধাগুলো সরকার সবার জন্য উন্মুক্ত রাখে এবং একজন নাগরিকের ব্যবহারের ফলে অন্য নাগরিকের ব্যবহারের সুযোগ কমে না। সাধারণত, এই ধরনের সেবা প্রদানের দায়িত্ব সরকারের ওপর থাকে, কারণ বেসরকারি খাত লাভজনক না হওয়ায় এই ধরনের সেবা প্রদানে আগ্রহী হয় না।
৫। বর্জনযোগ্যতার অভাব: গণদ্রব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর বর্জনযোগ্যতার অভাব। এর অর্থ হলো, একবার এই পণ্য বা পরিষেবাটি সরবরাহ করা হলে, যারা এর জন্য মূল্য পরিশোধ করছে না, তাদের এর ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, একটি রাস্তার সুবিধা সবাই উপভোগ করতে পারে, যারা কর দিচ্ছে তারাও এবং যারা দিচ্ছে না তারাও। তেমনি, জাতীয় নিরাপত্তা একজন নাগরিককে সুরক্ষা দিলে, সেই একই নিরাপত্তা অন্য নাগরিকদেরও সুরক্ষা দেয় এবং কাউকে এর থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।
৬। প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব: গণদ্রব্যের ক্ষেত্রে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। এর মানে হলো, একজন ব্যক্তি যখন কোনো গণদ্রব্য ব্যবহার করে, তখন অন্য কারো ব্যবহারের সুযোগ কমে না। যেমন, একটি রাস্তার সুবিধা যদি এক লাখ মানুষ ব্যবহার করে, তাহলে অন্য এক লাখ মানুষও একই রাস্তা ব্যবহার করতে পারে এবং তাদের ব্যবহারের সুযোগ কমে না। একইভাবে, জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একজন নাগরিককে সুরক্ষিত রাখলে, তা অন্য নাগরিকদেরও একইভাবে সুরক্ষিত রাখে।
৭। বাহ্যিক প্রভাব: গণদ্রব্যের ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রভাব বা Externalities একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মানে হলো, যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি গণদ্রব্য ব্যবহার করে, তার প্রভাব সমাজের অন্য সদস্যদের ওপরও পড়ে। যেমন, একটি সুন্দর পার্ক তৈরি হলে তা শুধু ব্যবহারকারীদেরই আনন্দ দেয় না, বরং আশেপাশের পরিবেশও উন্নত করে। এই ধরনের ইতিবাচক বাহ্যিক প্রভাবের কারণে সরকার প্রায়শই গণদ্রব্য সরবরাহ করে থাকে, কারণ ব্যক্তিগত বাজার এই ধরনের সুবিধা তৈরিতে উৎসাহিত হয় না।
উপসংহার: ব্যক্তিগত দ্রব্য এবং গণদ্রব্যের মধ্যেকার পার্থক্য মূলত তাদের ব্যবহার, সরবরাহ এবং মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। ব্যক্তিগত দ্রব্যগুলো সাধারণত বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়, যেখানে প্রতিযোগিতা এবং বর্জনযোগ্যতা কাজ করে। অন্যদিকে, গণদ্রব্যগুলো সমাজের সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং এর সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সাধারণত সরকারের ওপর বর্তায়। এই পার্থক্যগুলো বোঝা আমাদের অর্থনৈতিক নীতির কার্যকারিতা এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই ধারণাগুলো সমাজের সম্পদ বণ্টন এবং সার্বিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১। বর্জনযোগ্যতা
২। প্রতিদ্বন্দ্বিতা
৩। মূল্য নির্ধারণ
৪। গণদ্রব্য
৫। বর্জনযোগ্যতার অভাব
৬। প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব
৭। বাহ্যিক প্রভাব
এই দুটি দ্রব্যের ধারণার উৎপত্তি অর্থনীতিবিদদের দ্বারা হয়েছে এবং ১৮৫০-এর দশকে ফরাসি অর্থনীতিবিদ জুলিও-ফ্রেডেরিক ফ্যারেট গণদ্রব্য নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দেন। পরবর্তীতে, ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকান অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন গণদ্রব্যের বৈশিষ্ট্যগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন, যা আধুনিক অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে গণদ্রব্যের সরবরাহকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে।

